ফাস্ট ফুড তো চেনেন, কিন্তু স্লো ফুড?
‘ফাস্ট ফুড চাই না, আমরা স্লো ফুড চাই!’—এই স্লোগান লেখা একটা ব্যানার হাতে একদিন পথে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন কার্লো পেট্রিনি নামের এক ভদ্রলোক, তাঁর বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। আশির দশকে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা পশ্চিমা বিশ্বে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল ফাস্ট ফুড চেইন শপ। তরুণ প্রজন্মের কাছে তুমুল জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছিল। ইতালির রোমে স্প্যানিশ স্টেপস অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রাচীন এক নিদর্শন, ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ আর পর্যটকবেষ্টিত রাস্তাঘাটের জন্য বিখ্যাত একটি জায়গা। একদিন দেখা গেল সেই প্রাচীন রাস্তায় গড়ে উঠছে ম্যাকডোনাল্ডসের একটি অত্যাধুনিক শাখা। স্থানীয় ইতালীয় ও স্প্যানিশ অভিবাসীরা ঠিক করলেন, তাঁরা এর প্রতিবাদ করবেন। নির্মীয়মাণ ফাস্ট ফুড চেইন শপের সামনে তাঁরা বিক্রি করতে শুরু করলেন ঘরে তৈরি ঐতিহ্যবাহী পেনি পাস্তা। আর সঙ্গে প্ল্যাকার্ডও তৈরি হলো সেই বিখ্যাত উক্তি নিয়ে—‘আমরা ফাস্ট ফুড চাই না, আমরা চাই স্লো ফুড।’
রোমের সেই শহরতলির বাসিন্দারা তাঁদের প্রিয় প্রাচীন এলাকায় ফাস্ট ফুডের আগ্রাসন রুখতে পারেননি বটে, কিন্তু তাঁরা জন্ম দিয়েছিলেন এক আন্দোলনের, যা এখন বিশ্বব্যাপী ‘স্লো ফুড মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত। দিন দিন এই মুভমেন্টে অনেক বেশি মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। এই মুভমেন্ট ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। ওই ঘটনার তিন বছর পর, পেট্রিনি আর তাঁর সমমনারা প্যারিসে জড়ো হলেন আরও ১৫টি ইউরোপীয় দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। তৈরি হলো ‘স্লো ফুড মেনিফেস্টো’। বর্তমানে ১৬০টি দেশের লাখ লাখ মানুষ এই স্লো ফুড মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত।
কাকে বলে স্লো ফুড?
স্লো ফুড আন্দোলন সচেতনভাবেই ফাস্ট লাইফকে বর্জন করার পক্ষে। তাঁরা বলেন, খাদ্য হলো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। খাবার তৈরি, পরিবেশন এবং গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়াটিতে মাইন্ডফুলনেস (সচেতন মনোনিবেশ) এবং ‘মনের আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য’ জরুরি। এতে কোনো তাড়াহুড়া কাম্য নয়। তা ছাড়া খাদ্য উৎপাদনে স্থানীয় কাঁচামাল, মসলা, তেল ও ঐতিহ্য ধরে রাখার পক্ষে তাঁরা, নিজস্ব পারিবারিক রান্নাঘরই সেরা—এটাই তাঁদের ভাষ্য। ফাস্ট ফুড আসার পর মানুষের রোগবালাই যেমন বেড়েছে, তেমনি দেশে দেশে হারিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় ও নিজস্ব খাদ্যসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ। উনিশ শতকে ইউরোপের শহরগুলো তাদের ৯০ ভাগ ঐতিহ্যবাহী খাবার হারিয়ে ফেলেছে বলে তাঁরা গবেষণায় প্রকাশ করেছেন। প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি স্থানীয় সবজি, গাছড়া, মসলা ও গৃহপালিত প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। বিপন্ন হয়েছে আরও অনেক খাদ্য উপাদাননির্ভর বৃক্ষ গুল্ম। উল্টো দিকে আগে থেকে প্রক্রিয়াজাত ও দ্রুততম সময়ে পরিবেশন করা ফাস্ট ফুড সংস্কৃতি মানুষের স্বাদে-গন্ধের আনন্দের তীব্রতা কেড়ে নিয়েছে। নষ্ট করছে পরিবেশ। ফাস্ট ফুডের ক্ষেত্রে খাবারের অপচয়ের হারও বেশি।
স্লো ফুডের নীতিমালা
স্লো ফুড মুভমেন্টের সাতটা মূল নীতি আছে। সেগুলো হলো—
স্থানিক খাদ্যসংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে।
খাদ্য গ্রহণের আনন্দ পুরোপুরি আস্বাদ করতে দিতে হবে।
স্থানীয় কৃষি বা চাষাবাদকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ঐতিহ্যবাহী খাবারের ইতিহাস ও কাহিনির সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করাতে হবে।
পারিবারিক কৃষিকে উৎসাহ দিতে হবে।
অর্গানিক ও বাড়িতে বানানো খাবারে ফিরতে হবে।
কিশোর–তরুণদের বাগান করা ও গাছ লাগানোতে আগ্রহী করতে হবে।
খাদ্য তৈরি ও প্রক্রিয়াকরণের নামে পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না।
স্লো ফুড মুভমেন্টের সদস্যরা দেশে দেশে এমন কিছু রেস্তোরাঁ গড়ে তুলছেন, যেখানে পুরোনো পদ্ধতিতে আমাদের মা-দাদিরা যেভাবে খাবার তৈরি করতেন, আন্তরিকতার সঙ্গে খাবার পরিবেশন করতেন এবং সবাই মিলে একসঙ্গে খেতেন, সেভাবেই খাওয়া হয়।
আমাদের স্লো ফুডে ফেরা
গত কয়েক দশকে ফাস্ট ফুড সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে আমরাও আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ হারিয়ে ফেলছি। বাংলার পুলি পিঠা, ফুচকা, চটপটির জায়গা নিয়েছে বার্গার, পিৎজা, স্যান্ডউইচ। সন্দেশ বা রসগোল্লার স্থান গ্রহণ করেছে পেস্ট্রি, ওয়াফল বা চিজ কেক। এই প্রজন্ম আইসক্রিম চিনলেও কুলফি চেনে না। নানখাতাই বা বাকরখানি তো প্রায় বিলুপ্তই। কারণ, এখন টিনে বা প্লাস্টিকের প্যাকেটে নানা রকমের বিস্কুট বা কুকিজ মেলে। এখন আর বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় না নিমকি, পাঁপড়জাতীয় নাশতা। এভাবেই বিভিন্ন দেশের বর্ণাঢ্য খাবারের ইতিহাস বিলুপ্ত হচ্ছে। স্লো ফুড মুভমেন্ট এসব ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোকে ফিরিয়ে আনতে চায়। চায় আন্তরিকতা আর ভালোবাসার সঙ্গে খাবার তৈরি ও পরিবেশিত হোক। সে বাড়িতেই হোক বা রেস্তোরাঁয় অথবা উৎসব নেমন্তন্নে।