শাহজাহান ফারুকের মুখে কবীর সুমনের জার্মান–জীবনের গল্প
জার্মানিতে পরিচয়, সেখানেই বন্ধুতা। তারপর দীর্ঘদিনের যোগাযোগহীনতা। অবশেষে ঢাকায় গানের আসরে দুজনের নাটকীয়ভাবে দেখা। ঢাকার বন্ধু শাহজাহান ফারুকের মুখে ‘গানঅলা’ কবীর সুমনের জার্মান–জীবনের গল্প শুনলেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
জার্মানিতে একসময় পিয়ানো শিখতেন কবীর সুমন। প্রথম দিকে ঠিকঠাক পারতেন না। এ সময় তাঁর পিয়ানোশিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন, ‘এরপরও যদি না পারো, হাত ভেঙে দেব।’ প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে সেদিন আমাদের এ গল্প বলছিলেন ‘গানঅলা’র বন্ধু শাহজাহান ফারুক। বাংলাদেশের মানুষ শাহজাহানের সঙ্গে ওপার বাংলার সুমনের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা জার্মানির কোলন শহরে, জার্মান বেতার ডয়চে ভেলেতে কাজ করার সময়। এরপর অবস্থানগত কারণে এবং সময়ের নিয়মে দুই বন্ধুর মধ্যে ছিল অনেক দিনের যোগাযোগহীনতা। ১৭ অক্টোবর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে হারানো বন্ধু শাহজাহান ফারুককে যে আবার খুঁজে পাবেন সুমন, কে ভেবেছিল!
১৩ বছর পর গেল সপ্তাহে গান গাইতে আবারও বাংলাদেশে আসেন কবীর সুমন। গান নিয়েই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। ‘হঠাৎ রাস্তায় অফিস অঞ্চলে/ হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে/ বন্ধু কী খবর বল/ কত দিন দেখা হয়নি’ গাওয়ার পর কথায় কথায় বললেন, ‘১৯৭৬ সালে জার্মানিতে পালিয়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে জার্মান রেডিওতে কাজ নিলাম। সেখানে তখন বাংলাদেশের দুই ফারুক কাজ করতেন। একজন আবদুল্লাহ আল–ফারুক, আরেকজন শাহজাহান ফারুক। এই শাহজাহান ফারুকই আমাকে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বই বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা পড়তে দিয়েছিল। জানি না সেই শাহজাহান ফারুক এখন কোথায় আছেন। এখানে আছেন কি না।’
দর্শকসারি থেকে হঠাৎ একজন বলে উঠলেন, ‘শাহজাহান ফারুক এখানেই আছেন।’
শুনে সবার চক্ষু কপালে ওঠার জোগাড়। সুমনই বিস্ময় প্রকাশ করলেন প্রথম, ‘কী! এখানে!’
এরপর দর্শকসারি থেকে শাহজাহান ফারুককে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো মঞ্চে। প্রবল আবেগে দুই বন্ধু একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন, পরস্পরের মুখ ছুঁয়ে দিলেন পরম মমতায়। মুহূর্তেই গানের মঞ্চটি হয়ে উঠল দুই বন্ধুর মধুময় মিলনকেন্দ্র।
অতীতের সেই মধুর স্মৃতি
‘তিয়াত্তর বছর বয়সী সুমনের চোখে সে সময় ছিল জল। আপনার চোখেও কি পানি এসেছিল?’
কবীর সুমনের জার্মান–জীবনের গল্প শোনার জন্য তাঁর বন্ধু শাহজাহান ফারুককে ১৮ অক্টোবর যখন প্রশ্নটি করলাম, তখন কিছুক্ষণ কোনো উত্তর দিলেন না বাংলাদেশ বেতারের অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা। প্রশ্ন শুনে তাঁর মনে কি ভেসে উঠল দূর অতীতের স্মৃতি? ‘তখন আমি ত্রিশ পেরোনো যুবক। ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের সম্পাদক। আমি ছাড়াও ছিলেন বাংলাদেশের আবদুস সাত্তার, আবদুল্লাহ আল–ফারুক, নাজমুন নেসা পিয়ারি। এখানেই প্রদায়ক হিসেবে কাজ করত সুমন। খুব দ্রুত, ফটাফট লিখতে পারত। জার্মান থেকে বাংলায় অনুবাদে জুড়ি ছিল না। ছিল খুব আড্ডাবাজ আর দিলখোলা মানুষ। পরিচয়ের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমাকে সে আপনি থেকে তুই করে বলতে শুরু করে।’
পরের জীবনে যে মানুষটি ভিন্নধর্মী কথা আর গায়কি দিয়ে আধুনিক বাংলা গানে নতুন একটি ধারা সৃষ্টি করবেন, কোলনের সেই প্রবাসজীবনে সুমন গান তখন সেভাবে না গাইলেও সংগীত নিয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি করতেন। অন্তত শাহজাহান ফারুকের চোখে সেই সময়ের বছর ত্রিশের যুবক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের এই ছবিই ভাসে, ‘ডয়চে ভেলের নিয়মিত কর্মী ছিল না সুমন। কাজ থাকলে আসত। আসলে জীবন–জীবিকার তাগিদে ও তখন নানান কিছু করত। তখনই ওকে মিউজিক নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি—এই পিয়ানো শিখছে, তো ওই হারমোনিয়ামে মাতোয়ারা হয়ে আছে।’
কোলনের দিনরাত্রি
ডয়চে ভেলেতে এলে নাজমুন নেসা পিয়ারির সঙ্গে চলত তাঁর অম্লমধুর খুনসুটি। আর কাজ শেষে অফিসের নিচের ক্যাফেতে বসে আড্ডায় আসর গুলজার করা ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা।—এসব তথ্য জানানোর সঙ্গে সঙ্গে শাহজাহান ফারুক যোগ করলেন, ‘সে সময় কলকাতা ও বাংলাদেশ—দুই স্থানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই ছিল টালমাটাল। আমাদের আলাপে সেসব আসত। আর আসত সাহিত্যের প্রসঙ্গ।’
তাঁর কথা শুনে মনে পড়ল পয়লা দিনের অনুষ্ঠানে সুমনের একটি কথা, ‘আপনারা শহীদের (কাদরী) কবিতা পড়বেন। শহীদের কবিতা পড়লে কবিতা পড়ার বদভ্যাস তৈরি হয়।’ সেই ‘বদভ্যাস’ সুমনের আগেই ছিল নিশ্চয়। না হলে জার্মানির মতো বিদেশবিভুঁইয়ে বসে কেন বাংলাদেশের কবি শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ কবিতায় সুর দেবেন!
কথাটি পাড়তেই আবারও ফুটল শাহজাহানের মুখ, ‘সুমনের সঙ্গে শহীদ কাদরীর পরিচয় তো জার্মানিতেই। শহীদের প্রথম স্ত্রী ছিলেন নাজমুন নেসা পিয়ারি। তাঁর সূত্রেই কবির সঙ্গে আলাপ–সালাপ।’
শুধু কি তাই? নিজের গানে সুমন যে লিখেছেন, ‘এক ফালি মেঘ এক ফোঁটা জল/ রংধনুকের একটি কণায়’—জার্মানির হিমশীতল পরিবেশে বসে বাংলাদেশি বন্ধুজনদের কাছ থেকে এই ‘রংধনু’ শব্দ প্রথম জেনেছিলেন তিনি। কলকাতায় রংধনুকে সবাই বলে ‘রামধনু’। সুমনের গলায় তাই শোনা যায়, ‘বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমার ধারদেনার শেষ নেই।’
সুমন জার্মানিতে গিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে। ছিলেন ১৯৭৮ অব্দি। তাঁর দুই বছরের স্মৃতিচারণা করতে করতে শাহজাহান ফারুক বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন কোলন শহরে, ‘শিশুদের খুব পছন্দ করত সে, তাদের সঙ্গে মজা করতে পারত। আমার ছেলে অংশু তখন খুব ছোট। তাকে সে খুবই আদর করত। আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে সারা কোলন শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুমন—চোখ বুজলে এই দৃশ্য এখনো দেখতে পাই।’
কথা বলতে গিয়ে শাহজাহান ফারুকের চোখ আদতেই স্মৃতির নদীতে ডুবে গিয়েছিল। বললেন, ‘১৯৭৮ সালে ভয়েস অব আমেরিকায় চাকরি নিয়ে সুমন চলে গেল আমেরিকা। সে সময় তার প্রিয় হারমোনিয়ামটা আমার শিশুপুত্রকে দিয়ে বলেছিল, “অংশু বড় হয়ে এটা দিয়ে গান শিখবে।”’
মার্কিন বেতার সংস্থা ভয়েস অব আমেরিকায় সুমনের চাকরি হওয়ার পেছনে শাহজাহান ফারুকের খানিকটা ভূমিকা ছিল। ‘জার্মানির মার্কিন দূতাবাস থেকে একদিন ডয়চে ভেলেতে ফোন এল। জানতে চাওয়া হলো, সুমন কেমন লোক? বামপন্থার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি না? সেদিন আমি ওর সম্পর্কে খুবই ফার্স্ট ক্লাস সার্টিফিকেট দিয়েছিলাম। খানিকটা মিথ্যাও বলেছিলাম যে ও বামপন্থী নয়। এরপরই ভয়েস অব আমেরিকায় ওর চাকরিটা হয়ে যায়।’
এ ঘটনা শুনে পরে সুমন তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি জানি তো, তুই আমার ভালোই বলবি, আমার কিছু খারাপ থাকলেও তুই ভালোই বলবি...বন্ধু না আমরা!’
কথাবার্তা শেষে শাহজাহান ফারুককে যখন তাঁর গাড়িতে তুলে দিচ্ছি, জিজ্ঞাসা করলাম, সুমনের কোন ছবিটি মনের কোণে এখনো সাজিয়ে রেখেছেন?
শাহজাহানের উত্তর, ‘জিনস, জ্যাকেট আর শু পরা এক যুবক, হালকা–পাতলা গড়ন, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এসেই চারপাশ মাতিয়ে হইহই করে উঠছে!’
৪৬ বছর আগে জার্মানিতে যেমন ছিলেন, গানওলা কবীর সুমন তো এখনো তেমনই—এসেই আসর মাতিয়ে তুলতে পারেন, তাই না!