সাগরতলের শামুক-ঝিনুকশিল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ফুটে উঠল যে প্রদর্শনীতে
সমুদ্রের নীল রঙের জলরাশির নিচে আছে আমাদের অদেখা এক জগৎ। সেই জগতের নানান রকম সামুদ্রিক উপাদান দিয়ে তৈরি হরেক কারুশিল্পের এক প্রদর্শনী হয়ে গেল ঢাকার বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে। প্রদর্শনী ঘুরে এসে লিখলেন আবু দারদা মাহফুজ
বঙ্গোপসাগরের তলদেশ হাজারো সামুদ্রিক জীবের সুবিশাল বিচরণক্ষেত্র। এই জগতে আছে মলাস্কা পর্বের অন্তর্ভুক্ত হাজারো রকমের সামুদ্রিক প্রাণী। মলাস্কা প্রাণিরাজ্যের সদস্যরা আমাদের কাছে সাধারণত ঝিনুক বা শামুক হিসেবেই পরিচিত। এই ঝিনুক-শামুক ব্যবহৃত হয় খাদ্য ও ওষুধ হিসেবে। মুক্তা চাষেও এর বিকল্প নেই, আছে আরও উপযোগিতা। এসবের বাইরে ঝিনুক-শামুক দিয়ে তৈরি হয় ঘরের শোপিস থেকে শুরু করে ফ্যাশন অনুষঙ্গ। মূলত সাগরতলের এসব মলাস্কা দিয়ে তৈরি পরিধেয় অলংকারসহ আরও কিছু কারুশিল্প প্রদর্শিত হলো ‘সমুদ্রে শিল্পের খোঁজ’ শীর্ষক এক বিশেষ শিল্পকর্মের প্রদর্শনীতে।
গত ৩০ জুলাই থেকে ২ আগস্ট চার দিনব্যাপী প্রদর্শনীর আয়োজন বসেছিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী মিলনায়তনে। দেশে ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সুনীল অর্থনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে প্রদর্শনীটির আয়োজন করে ‘মনসিজ ক্র্যাফট’। সহযোগী হিসেবে ছিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ ম্যাচবক্স কালেক্টরস ক্লাব, ফেবিক্রিল এবং মনসিজ আর্ট একাডেমি। এ ছাড়া প্রদর্শনীর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত ছিল শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি।
কেন এই আয়োজন
প্রধান আয়োজক প্রতিষ্ঠান মনসিজ ক্র্যাফটের কর্ণধার কারুশিল্পী সাদিয়া শারমিন জানান, জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি আন্তসংযুক্ত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১৪ নম্বর লক্ষ্যমাত্রাটি হলো ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ এবং সঠিক ব্যবহার’, যা ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি নামে পরিচিত। এই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই সামুদ্রিক ঝিনুক, চাষযোগ্য ঝিনুক এবং শামুকভিত্তিক মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চার বছর ধরে পরিধানযোগ্য শিল্পে ঝিনুকের ব্যবহার নিয়ে সাদিয়া ও তাঁর প্রতিষ্ঠান মনসিজ ক্র্যাফট গবেষণাধর্মী কাজ করে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় চার দিনব্যাপী বিশেষ এই প্রদর্শনীর আয়োজন।
সাগরতলের ঝিনুক নিয়েই কেন আগ্রহ তা জানতে চাইলে সাদিয়া শারমিন জানান, করোনা মহামারির সময় যখন বিশ্ব অর্থনীতি থমকে দাঁড়ায়, তখন কক্সবাজারের ঝিনুক ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন তাঁর নজরে আসে। পরবর্তী সময়ে তিনি আরও জানতে পারেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে এই ঝিনুক শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এটি নিয়ে তেমন উদ্যোগ নেই। একজন কারুশিল্পী হিসেবে দেশের জন্য ভিন্ন কিছু করার তাগিদ থেকেই গবেষণাটি শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে গবেষণাকর্ম আর ফ্যাশনশিল্পে ঝিনুকের ব্যবহারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রতিষ্ঠা করেন মনসিজ ক্র্যাফট এবং মনসিজ আর্ট একাডেমি।
যেভাবে এগিয়ে চলেছেন
মনসিজ ক্র্যাফট সমুদ্র উপকূল থেকে মৃত ঝিনুক বা শামুক আহরণ করে নিজেদের দক্ষ কারুশিল্পী দিয়ে শিল্পরূপ দান করে। পরে সেসব পরিধেয় কাপড়ের সঙ্গে বা অলংকার হিসেবে বাজারজাত করে। এতে ফ্যাশনশিল্পে ঝিনুকের ব্যবহারের নতুন একটি ধারার প্রসার হচ্ছে। সাদিয়া মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন।
বঙ্গোপসাগর থেকে সামুদ্রিক ঝিনুক বা শামুক আহরণ করে শিল্পরূপ দিয়ে বাজারজাত করলে তা জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে কি না, তা জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, ‘মনসিজ ক্র্যাফট সমুদ্র থেকে শুধু মৃত শামুক বা ঝিনুকই আহরণ করে। ফলে আমাদের হাত ধরে দেশে এ ধরনের শিল্প বিকশিত হলে তা জীববৈচিত্র্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।’
সাদিয়া আরও বলেন, ‘আমাদের সমুদ্র উপকূলগুলোতে প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ধীরে ধীরে মলাস্কাস পর্বের প্রাণী বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।’
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে ভেসে আসা মৃত তিমির পেট থেকে প্রায় ৪০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য উদ্ধারের ঘটনা উল্লেখ করে সাদিয়া বলেন, প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী প্রাণ হারাচ্ছে শুধু অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে। তাই দেশের সমুদ্র উপকূলে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে তা অদূর ভবিষ্যতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক সংকট তৈরি করবে।
তবে মনজিস ক্র্যাফটের এই উদ্যোগ এখনো পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়নি। এখন এটি গবেষণা পর্যায়ে আছে। প্রতিষ্ঠানটি এ রকম প্রদর্শনীর মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে নিজেদের গবেষণা, দেশে এই শিল্পের সম্ভাবনা এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে প্রতিনিয়ত বার্তা দিয়ে যাচ্ছে। সাদিয়া শারমিন বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি। সরকারের সহযোগিতা পেলে দেশে এই শিল্পকে সফল করে তুলতে পারব।’
প্রদর্শনীতে যা যা ছিল
প্রদর্শনীতে ঢুকতেই মনে হলো, সমুদ্রই দেখছি! দেয়ালে বিশাল আয়তাকার ক্যানভাসে আঁকা কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের ছবি। সংখ্যায় শতাধিক। ছবিগুলো এঁকেছেন বিভিন্ন শিল্পী।
প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ তাদের সংগ্রহশালা থেকে মলাস্কা প্রাণিরাজ্যের ২৯টি শামু্ক ও ঝিনুক, ৫টি প্রবাল ও ৩১টি পাখির ট্যাক্সিডার্মিসহ মোট ৬৫টি নিদর্শন প্রদর্শন করেছে যৌথভাবে।
১০টি মলাস্কাকে কেন্দ্র করে মনসিজ আর্ট একাডেমির ১০ জন খুদে শিল্পীর চিত্রকর্ম ১০টি ভিন্ন ম্যাচবক্সে প্রকাশিত হয়েছে এই প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক সম্পদ, সমুদ্রের প্রতি নির্বিচার আচরণ এবং এ বিষয়ক সচেতনতাকে কেন্দ্র করে সাদিয়া শারমিনের তত্ত্বাবধানে ৪৭ জন শিল্পীর ১ মাসব্যাপী কর্মশালার মধ্য দিয়ে ১০টি ক্র্যাফট, ১০টি ম্যাচ বাক্স, পরিধানযোগ্য শিল্পের ৭টি পেইন্টিং, ৫৯টি সুপারি প্লেট পেইন্টিং, ৬৫টি সিডি পেইন্টিং, ৭টি ক্যাপ পেইন্টিং এবং ১৬টি সমুদ্রবিষয়ক পেইন্টিং তৈরি হয়েছে। সবই ছিল প্রদর্শনীতে।