শাশুড়ি স্মরণে খুশবুল শাড়ি
আবদুল জলিল আর ফিরোজা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। বিয়েতে এত সাজগোজের বালাই তখন ছিল না। বিয়ের অনেক পরে এ দম্পতির ছেলের বউ মাশিয়াত মাসুদ লাল টুকটুকে খুশবুল শাড়ি আর তাঁর নিজের বিয়ের কিছু গয়না পরিয়ে সাজিয়ে দেন ফিরোজা খাতুনকে। ছেলের বউয়ের বায়না মেটাতে বুড়ো বয়সে ফিরোজা খাতুন মুখে নতুন বউয়ের লাজমাখা হাসি নিয়ে ছবি তুলেছেন আবদুল জলিলের সঙ্গে। ফেসবুকের ‘ভারমিলিয়ন’ নামের পেজে এ ছবি পোস্ট করেছেন মাশিয়াত মাসুদ। লাল টুকটুকে খুশবুল শাড়িটা বানিয়েছেন পেজটির তিন উদ্যোক্তা ফেরদৌস আরা, ইফফাত আরা ও ইমতিয়াজ ইসলাম।
খুশবুল শাড়ির পেছনেও আছে আরেক শাশুড়ির গল্প। ফেরদৌস আরা জানালেন, তাঁর শাশুড়ির নাম ছিল রাজিয়া সুলতানা, ডাক নাম খুশবুল। খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। ৯ বছর আগে মারা গেছেন তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর খুব রঙিন শাড়ি পরতেন না খুশবুল। প্রাইডের থান কাপড় কিনে একই রঙের সুতা দিয়ে নকশা করে সেই শাড়ি পরতেন। সব সময় শাড়িতে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশের শাড়ির জগতের প্রথম সুপরিচিত ব্র্যান্ড মালা শাড়ি পরে ১৯৬৯ সালে রাজিয়া সুলতানার বিয়ে হয়েছিল। উত্তরসূরি হিসেবে আরও অনেক শাড়ির সঙ্গে মালা শাড়িটিও পেয়েছিলেন ফেরদৌস আরা। শাড়িটি আলমারিতেই তুলে রাখা ছিল।
২০২১ সালে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মারা গেলে নতুন করে আবার আলোচনায় আসে এ মালা শাড়ি। কারণ, ১৯৬৮ সালে এই আনোয়ার হোসেনই আনোয়ার সিল্ক মিলস প্রতিষ্ঠা করে মালা শাড়ি বাজারে আনেন। তাঁর মৃত্যুতে অনেকেই তাই নিজের কাছে থাকা মালা শাড়ির ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তাঁকে স্মরণ করেন। ওই সময় ফেরদৌস আরা শাশুড়ির বিয়ের শাড়িটি বের করে নতুন করে মুগ্ধ হন। ফেরদৌস আরা প্রথম আলোকে বলেন, মালা শাড়ি দেখেই মূলত পুরোনো ধাঁচের শাড়ি বানানোর কথা মাথায় আসে। শাশুড়ির বিয়ের শাড়ি দেখে অনুপ্রাণিত হওয়ার কারণে লাল টুকটুকে পুরোনো ধাঁচের শাড়ির নাম দেওয়া হয় খুশবুল। শাড়িটি অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ফেরদৌস আরা জানালেন, তাঁরা চার বোন। ছোটবেলা থেকেই মা নিজের হাতে জামা বানিয়ে দিতেন, আর ওই জামায় ফুল-পাতা বা বিভিন্ন নকশা করে তাতে নতুনত্ব আনতেন ফেরদৌস আরা ও অন্য বোনেরা। ফেরদৌস আরার ছোটবেলা থেকেই বুটিক শপ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। ২০১৪ সালে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় থেকেই বুটিক শপের কাজ শুরু করেন। আর এতে যুক্ত হন ছোট বোন ইফফাত আরা আর তাঁর স্বামী ইমতিয়াজ ইসলাম।
ফেরদৌস আরা বলেন, মালা শাড়ি বিখ্যাত ব্র্যান্ড। সেই ব্র্যান্ডকে নকল করে বা একদম কাছাকাছি নকশা যাতে না হয়, সে দিকে বরাবরই নজর রাখা হয়েছে। ভারমিলিয়নের বেশির ভাগ শাড়ির নকশা করেছেন ছোট বোন ও তাঁর স্বামী। এ শাড়িতেও তাঁরাই কাজ করেছেন।
ফেরদৌস আরা জানালেন, পুরোনো ধাঁচের শাড়ি বানাতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয় জরি সুতা পেতে। এখনকার সুতার সোনালি রং মসৃণ, কিন্তু আগের দিনের শাড়ির সুতাগুলো এত মসৃণ ছিল না, আর রংটাও ছিল হলদে সোনালি। আর লালও বেছে নেওয়া হয়েছে আগের দিনের মতো টুকটুকে লাল রং। শাড়িটি পুরোনো ধাঁচের হলেও এ কালের শহুরে নারীরা যাতে পছন্দ করেন বা তাঁদের রুচির সঙ্গে যায়, সে দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ শাড়ি নিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। শাড়িটির দাম রাখা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা।
ফেরদৌস আরার বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি—দুটোই সুনামগঞ্জে। পাঁচ বছর বয়সী এক ছেলে এবং আইনজীবী স্বামী ফজলে আমিনকে নিয়ে সেখানেই থাকেন তিনি। সুনামগঞ্জ শহরে ভারমিলিয়নের একটি আউটলেট আছে। ঢাকা বা বাইরে থেকে সুনামগঞ্জে আসা মানুষই মূলত তাঁর ক্রেতা। টুকটুকে লাল খুশবুলের পাশাপাশি গাঢ় কলিজা রঙের আরেকটি শাড়িও বানিয়েছেন এই তিন উদ্যোক্তা। ফেরদৌস আরা বললেন, অনেকেই লালের বদলে অন্য রঙের কথা বলায় রঙে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করা হয়েছে। ফেরদৌস আরা বললেন, ‘শাশুড়ির নামে শাড়ি বানানোতে আমার স্বামী ও তাঁর অন্য ভাইবোনেরাও খুব খুশি। আটপৌরে মায়ের গল্প আবার সবাই জানতে পারছেন, তাঁকে স্মরণ করেছি, তাই তাঁরা খুশি হয়েছেন।’
বিয়ের লাল টুকটুকে শাড়ির প্রতি ফেরদৌস আরারও দুর্বলতা আছে। জানালেন, বিয়ের সময় পড়াশোনার জন্য স্বামী দেশের বাইরে থাকায় তাঁদের বিয়ে হয়েছিল মুঠোফোনে ভিডিও কলে। দেশে বিয়ের অনুষ্ঠান হলেও লাল টুকটুকে শাড়ি পরে স্বামীর সামনে যাওয়ার যে শখ ছিল, তা-ও পূরণ হয়নি। তিনি বললেন, ‘ইচ্ছা আছে শাশুড়ির শাড়িটি পরে বিয়ের কনের সাজে স্বামীর সঙ্গে একটি ছবি তুলব।’
হোটেল লা মেরিডিয়ান এবং যাত্রার পার্টনার হিসেবে রাজধানীতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের আউটলেটে ভারমিলিয়নের ভাড়া করা একটি কর্নার আছে। ঢাকায় নিজেদের একটি আউটলেট করার স্বপ্ন দেখছেন ফেরদৌস আরা। ফেরদৌস আরা বললেন, ‘আলমারিতে শাশুড়ির আরও অনেক শাড়ি আছে, যার অনেকগুলোই এখন বিলুপ্তপ্রায়। এগুলো দেশের ঐতিহ্য। এই শাড়িগুলোতে বিভিন্ন জিনিস সংযোজন করে নতুন শাড়ি বানাতে কাজ করব আমরা। নিজেদের একটি তাঁত থাকলে কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাবে।’