শাড়িগুলো বেশ জমকালো। এক দেখাতেই চোখ আটকে যায়। কোনোটি সুতি, কোনোটি খাদি। রঙেও ছিল বৈচিত্র্য। তবে নকশাই দর্শকের নজর কেড়েছে বেশি। ফুটে উঠেছে চট্টগ্রামের নৈসর্গিক ফয়’স লেক, পুরোনো রেলস্টেশন, চেরাগি পাহাড়ের প্রতিকৃতি কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’। ৮ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে ‘আদি মোহিনীমোহন কাঞ্জিলাল-প্রথম আলো ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা’য় দর্শকের মনজয় করে নেয় এসব শাড়ি। বিচারকেরাও মুগ্ধ হন। চট্টগ্রাম নগরের পাঁচ তারকা হোটেল র্যাডিসন ব্লুতে বসে ফ্যাশনের এই আয়োজন। চট্টগ্রামে নিয়মিত এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে প্রথম আলো। এবার ছিল ২৩তম আসর। এতে হাল আমলের পোশাক তুলে ধরেন ডিজাইনাররা। পোশাকে ছিল ঈদের আমেজ।
প্রতিযোগিতায় শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শার্ট, টি-শার্ট, কুর্তা, ফিউশন ও যুগলদের পোশাক তুলে ধরেন হাজেরা খানম। সেরাদের সেরা ছাড়াও আরও ছয়টি পুরস্কার জিতে নেন এই ডিজাইনার। তাঁর নকশায় ছিল বৈচিত্র্য। ছিল ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেল, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। এই যেমন, টপসে উঠে এসেছে মেক্সিকান ফ্যাশন আইকন ফ্রিদা কাহলোর অবয়ব, লেহেঙ্গায় নকশি কাঁথার ফোঁড়।
জমজমাট আসর
এবারের প্রতিযোগিতায় ছয়টি বিভাগে ৩৮ জন ডিজাইনারের ২২৮টি পোশাক জমা পড়ে। প্রাথমিক বাছাই শেষে চূড়ান্ত পর্বের জন্য মনোনীত হয় ৪২টি পোশাক। বাছাই করা এসব পোশাক পরে মঞ্চে দ্যুতি ছড়ান মডেলরা।
প্রথম কিউতে বাহারি নকশার শাড়ি পরে হাজির হন সাত মডেল। নানা রঙের এসব শাড়ি মুহূর্তেই কেড়ে নেয় দৃষ্টি। বাদামি, সাদা, হালকা সাদা, টিয়া প্রভৃতি রঙে তৈরি শাড়িগুলো মঞ্চ আলোকিত করে।
এরপর সারারা ও পাঞ্জাবি পরে মঞ্চে ওঠেন মডেলরা। মিলনায়তনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে নজরুলের জনপ্রিয় গান ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’-এর সুরের আবেশ। তপ্ত গরমে হবে এবার ঈদ। তাই পোশাক তৈরিতে আরামদায়ক কাপড়ের দিকেই নজর রেখেছেন ডিজাইনারেরা। সিল্ক, সুতিসহ নানা কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে রং ছিল মেরুন, গোলাপি, সাদা-কালো।
পাঞ্জাবির পর ছিল আরও চমক। সালোয়ার-কামিজে দেখা গেল গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। মডেলরা যখন হাঁটছিলেন, তখন বাজছিল শচীন দেববর্মনের ‘শোনো গো দখিন হাওয়া’। ফ্যাশন কিউর একপর্যায়ে যুগল পরিবেশনা নিয়ে হাজির হন ১৪ জন মডেল। সবশেষে ছিল আদি মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের শাড়ি ও লেহেঙ্গার দুটি কিউ।
যাঁদের হাতে পুরস্কার
প্রতিযোগিতায় এবার যাঁরা পুরস্কার পেলেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ। পোশাকের নকশাতেও ফুটে ওঠে তারুণ্য। প্রদর্শনীর পর বিচারকদের চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে পুরস্কার পান ৯ জন ডিজাইনার। হাজেরা খানম ছাড়া অন্যরা হলেন আয়শা রুবাইয়াত, আয়ান নিজাম, রিদুয়ান উল আলম, ফারিহা হাসিন, আছমা বেগম, শারমিন আক্তার, নাসরিন সুলতানা ও অয়ন।
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাশন ডিজাইন টেকনোলজিতে স্নাতক করেছেন রিদুয়ানুল উল আলম। প্রথমবারের মতো তিনি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, যুগল ও ফিউশন—চার বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর নকশা করা পোশাক। থিম ছিল ‘শিমুল তুলায় নতুনত্ব’। রিদুয়ানুল জানালেন, শীতকালীন ফুল শিমুলকে পোশাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
২০১৬ সাল থেকে পোশাকের নকশা করছেন ফারিহা হাসিন। তাঁর অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের নাম ‘নীলাম্বরী’। পাঞ্জাবিতে অভিনব নকশা করে পুরস্কার ঘরে তুলেছেন এই তরুণ ডিজাইনার। ফারিহা জানালেন, হ্যান্ডপেইন্ট, কারচুপি, ব্লকের কাজ করেন তিনি। নকশায় সব সময় নতুন কিছু উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন।
পাশ্চাত্য ধাঁচের নকশার সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলেছেন ডিজাইনার আয়ান নিজাম। এই ডিজাইনার বললেন, বিশ্বব্যাপী ফ্যাশনের নতুন ধারা অনুসরণ করেন তিনি। এই শিল্পের হালনাগাদ তথ্য রাখেন।
এ বছর বিচারক ছিলেন ডিজাইনার রওশন আরা চৌধুরী, আইভি হাসান, এইচ এম ইলিয়াস, সুলতানা নূরজাহান ও আশরাফুল ইসলাম। কোরিওগ্রাফার ছিলেন বুলবুল টুম্পা।
কেমন ছিল প্রতিযোগীদের এবারের পোশাক, জানতে চাইলাম আইভি হাসানের কাছে। দুটি মিলের কথা জানালেন তিনি। তাঁর মতে, এবার বেশির ভাগ ডিজাইনারই ছিলেন তরুণ। আবার পোশাকেও ছিল তারুণ্যের স্পন্দন। আইভি হাসান বলেন, পাশ্চাত্যের সঙ্গে দেশীয় আভিজাত্য দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন ডিজাইনাররা। তাঁদের কাজে ছিল নতুনত্ব। সব মিলিয়ে জমজমাট এক আয়োজন হলো।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে বক্তব্য দেন আদি মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের বাংলাদেশ শাখার কর্ণধার শিবলি মাহমুদ, জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল, বার্জার পেইন্টসের আঞ্চলিক বিক্রয় ব্যবস্থাপক শেখ মোহাম্মদ আবু ফারুক ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, হেড অব কালচারাল প্রোগ্রাম কবির বকুল প্রমুখ। ২০২১ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ভারতীয় পোশাক বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠান আদি মোহিনীমোহন কাঞ্জিলাল। বর্তমানে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের দুটি শোরুম রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে।