কালো বেনারসিটা আর আছে?
(হাসতে হাসতে) নেই। সব বিক্রি হয়ে গেছে। আসলে তিনটা রঙের ওপর হয়েছিল। খয়েরি, কালো আর ইনডিগো। যদিও কালোটাই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে। সমাদৃত হয়েছে। কালোর বেশ কয়েকটা কালেকশন ছিল। বেনারসি সাধারণত ইন্ডিয়ান সিল্কে হয়। তবে আমরা করেছি পিওর সিল্কে, যাতে জমকালো পোশাকটা আরামদায়ক হয়। আড়ংও পিওর সিল্কে কিছু বেনারসি করে। এগুলোকে বলা যেতে পারে ‘ঢাকাই বেনারসি’।
প্রথম আলো :
আপনার কালেকশনগুলোর দাম কেমন ছিল?
৩৫ হাজার টাকা থেকে শুরু। ৫০ হাজারের ওপরে না।
প্রথম আলো :
শুরু থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনার হতে চেয়েছেন?
হ্যাঁ, একদম। খুব ছোটবেলায় খুলনায় পরিবারের সঙ্গে যখন ঈদের কেনাকাটা করতে যেতাম, বাজারে গিয়ে আমার কিছুই পছন্দ হতো না। সবাই কিনত, আমি কিনতে পারতাম না। শেষ মুহূর্তে কিছু একটা কেনা হতো। সেটা গায়ে চাপিয়ে ঈদের সারাটা দিন মন খারাপ করে থাকতাম। আমার ছোটবেলা থেকেই সেলাইয়ের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। নানিবাড়ি ছিল যশোরের ঝিকরগাছার কাগমারী গ্রামে। ওই গ্রামের নারীরা মাটির বারান্দায় উঠানে বসে সেলাই করতেন। আমি মন দিয়ে দেখতাম। নিজে নিজে চেষ্টা করতাম।
মা সেলাই করত?
না, মা করত না। তবে খালামণিরা করত। আর এ কারণেই মায়ের চেয়ে খালামণিদের সঙ্গে আমার সখ্য বেশি ছিল। ৮ বা ৯ বছর বয়স থেকেই আমি পছন্দমতো কাপড় কিনে ঘরে দরজা লাগিয়ে নিজে নিজে সেলাই করতাম। তারপর এলাকার টেইলরের কাছে পাঞ্জাবি বানাতে দিতাম। তখন থেকে মোটামুটি আমার ঈদ শুরু হলো।
প্রথম আলো :
আপনার কাজে ঘুরেফিরে একই ধরনের কিছু রঙের ব্যবহার দেখা যায়। পাইন গ্রিন, মস গ্রিন, অন্য রকম সব সবুজ, গেরুয়ার বিভিন্ন শেড...আপনার রঙের অনুপ্রেরণা কী?
পুকুরের শেওলার রং আমাকে প্রথম মুগ্ধ করেছিল। নানিবাড়ি গিয়ে পুকুরের শেওলা দেখে অবাক হয়ে গেছি। আমি ছোটবেলা থেকে কখনো খুব ‘ভাইব্রেন্ট’ রং পরিনি। মাটির রং, পানির রং, খড়ের রং—প্রকৃতির এসব রং আমার কী যে ভালো লাগত! আমি বলতাম, ‘দাঁড়া, দাঁড়া, এই রং একটু দেখে নিই।’ আমার কাজিনরা নিজেদের ভেতর বলাবলি করত, আমি নাকি পাগল! স্কুল বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি গ্রামে যাওয়ার জন্য কান্না শুরু করতাম। আমার মা মামাদের ফোন করে বলত, আমাকে নিয়ে যেতে। ছুটির পুরো সময়টা আমি নানিবাড়ি কাটাতাম। মাটির সোঁদা ঘ্রাণ, পাটের ঘ্রাণ, রং—এসব আমার ভালো লাগত। কাগমারীতে ছোটবেলার একটা বড় সময় না কাটলে আমি এখন এ রকমভাবে ডিজাইনার হতে পারতাম কি না, কে জানে! একটু বড় হওয়ার পর খুলনার আড়ংয়ে গিয়ে সুতি, সিল্কের কাপড়গুলো ধরে দেখা, রং দেখা, ডিজাইন দেখা—এগুলো শুরু করলাম। রঙের ক্ষেত্রে প্রকৃতি–ই আমার অনুপ্রেরণা!
প্রথম আলো :
আপনার মা–বাবা কী করতেন? কয় ভাই-বোন? তাঁরা কী করে?
আমাদের খুবই সাধারণ একটা পরিবার। বাবা ব্যবসা করতেন। মা গৃহিণী। বড় দুই ভাইও জেনারেল লাইনে পড়াশোনা শেষে ব্যবসা করছে। তিন ভাইয়ের ভেতর আমি সবার ছোট। আমার চৌদ্দগোষ্ঠীতে কোনো ডিজাইনার তো দূরের কথা, ক্রিয়েটিভ লাইনেই কেউ নেই। আমার ভেতর কীভাবে সেলাই, রং, ডিজাইন ব্যাপারটা ঢুকল, আমি জানি না। আমার কোনো ধারণা নেই।
প্রথম আলো :
আপনি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে কীভাবে এলেন?
এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। তারপরও বাসা থেকে বলা হলো, বাবার ব্যবসার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার অনেক খরচ। অনেকগুলো প্রাইভেট টিউটর রাখতে হবে। বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আমাকে আর্টস নিয়ে পড়তে বলা হলো। এই নিয়ে আমার ভীষণ মন খারাপ ছিল। উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় এসে একদিন পত্রিকায় দেখলাম, বিবিয়ানাতে লোক নেবে। সেলসম্যান। কিছু না বুঝেই ভাইভার দিন হাজির হয়ে গেলাম (বিবিয়ানার স্বত্বাধিকারী ও প্রধান ডিজাইনার) লিপি খন্দকারের সামনে। আমারই নকশা করা একটা পাঞ্জাবি পরে গিয়েছিলাম। ধানমন্ডি ৬-এর শোরুমে। লিপি আপা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি তো বাচ্চা একটা ছেলে। এখানে কী করবে?’ বললাম, ‘যা বলবেন, তাই-ই করব।’ উনি জিজ্ঞাসা করলেন, পাঞ্জাবিটা কোথায় পেয়েছি। জানালাম, নিজেই করেছি। আমি কত রকমের সেলাই পারি, জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, ৩০ থেকে ৩৫ রকমের। তারপর আমি যে নিজে নিজে নকশা করি, কাগজ কেটে বা এঁকে—সেগুলোর ফাইলটা নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি দেখে অবাক হলেন। আমাকে কাজে নিয়ে নিলেন। সেটা ছিল ২০০৮ সালের মাঝামাঝি একটা সময়। পরদিন কাজে গেলাম। উনি আমাকে কাগজ, পেনসিল দিয়ে কাজ বুঝিয়ে দিলেন। পাঞ্জাবিতে নকশা আঁকতে হবে। আমি নকশা এঁকে নিয়ে গেলাম। উনি দেখে বললেন, এই নকশা হবে (ঢালিউড তারকা) রাজ্জাকের লাল অ্যান্ডি সিল্কের পাঞ্জাবিতে। আর বেজ রঙের একটা সিল্কের শাড়িতে ব্লক করতে বললেন। তখন আমি ব্লক কী বুঝিনি। উনি বললেন, দেখিয়ে দিচ্ছি। পারবে। সেই শাড়ি পরবেন (ঢালিউড অভিনেত্রী) কবরী। রাজ্জাক-কবরী জুটি তখন তুমুল জনপ্রিয়। তাঁরা উত্তরায় বিবিয়ানার নতুন শোরুম উদ্বোধন করবেন ওই শাড়ি–পাঞ্জাবি পরে। মানে, আমি জীবনের প্রথম কাজটাই করেছি রাজ্জাক-কবরী জুটির।
আর পড়াশোনা?
ওখানে কাজ করতে করতেই জানলাম, লিপি আপা আর ওনার স্বামী দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়েছেন। আমার মনে হলো, আমাকেও তাহলে ডিজাইনার হওয়ার জন্য চারুকলায় পড়তে হবে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ফরম তুললাম, ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলাম না। তারপর ভর্তি হয়ে গেলাম ঢাকা কলেজ, দর্শন বিভাগে। এক বছর বিবিয়ানাতে কাজ করেছি। ‘অফিশিয়ালি’ এক বছর ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগে পড়েছি। কিন্তু কোনো দিন কোনো বইয়ের পাতা উল্টে দেখিনি। এরপর আমার পরিচয় হলো কবি সুফিয়া কামালের ছোট মেয়ে টুলু (সাঈদা কামাল) আপার সঙ্গে। ওনার সঙ্গে আমার খুব ভালো একটা সম্পর্ক হলো। আপা আমাকে আদর করে ডাকতেন ইমু। এই নামে কেবল উনিই ডাকতেন। সবার সঙ্গে ইমু নামে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আমি ওনাদের বাসায় থাকতে লাগলাম, যেখানে সুফিয়া কামাল থাকতেন। ‘সাঁঝের মায়া’। আমি ওনাকে জানালাম যে আমি ফ্যাশন নিয়ে পড়তে চাই। কী করব? উনি (ফ্যাশন ডিজাইনার) বিবি (রাসেল) আপার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিবি আপা প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। উনি বললেন, ‘আমি তো পড়াশোনা জানা ছাড়া কাজে নিই না। তুমি এক কাজ করো। লন্ডন থেকে, অন্তত ভারত থেকে আগে ফ্যাশন ডিজাইনে পড়াশোনা করো!’
প্রথম আলো :
আপনার জন্য তো তখন দেশে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই কঠিন!
একদম। তখন টুলু আপা আমাকে বললেন শান্ত-মারিয়ামে ভর্তি হয়ে যাওয়ার জন্য। এইখানে আমার একটা বন্ধুর কথা না বললেই নয়। ওর নাম কানিজ ফাতেমা। ও তখন লন্ডনে পড়াশোনা করত। ও আমাকে ৩০ হাজার টাকা পাঠাল ভর্তির জন্য। আমি ঢাকা কলেজ ছেড়ে শান্ত-মারিয়ামে ভর্তি হলাম ২০১১ সালে। বিবিয়ানা ছাড়লাম। কেননা, পড়াশোনায় মন দিতে হবে। ২০১৩ সালে আমি টুলু আপার বাসা ছেড়ে মালিবাগে আমার এক আন্টির বাসায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে উঠলাম। সকালে ভার্সিটিতে যেতাম। ক্লাস শেষ করে ছোট ছোট বুটিক হাউসে ফ্রিল্যান্সিং করতাম, অর্ডারের কাজ করতাম, টিউশনি করতাম। সব শেষ করে ঘরে ফিরে আবার নিজের পড়াশোনা, প্র্যাকটিক্যাল কাজ করতাম। রাতে খুব কমই ঘুমিয়েছি। এই চার বছর আমি বোধ হয় গড়ে তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। পাগলের মতো কাজ করেছি, পরিশ্রম করেছি। বাসা থেকে একটা টাকাও নিইনি। বাসায় জানত-ও না যে আমি শান্ত-মারিয়ামে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ভর্তি হয়েছি। একেবারে শেষ পর্যায়ে জানিয়েছি। নবম সেমিস্টারে গিয়ে টাকার অভাবে রেজিস্ট্রেশনই করতে পারিনি। ওই সময় আমি কেঁদেছিলাম যে এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার পরও আমার পড়াশোনা নিয়ে এ রকম স্ট্রাগল করতে হচ্ছে, স্নাতক করাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে! ঢাকা শহরে থাকা, খাওয়া, চলাফেরা করা আর প্রতি ছয় মাস পরপর ৪০ হাজার টাকা ফি দেওয়া, সেই সঙ্গে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের মতো একটা খরুচে বিষয়ে পড়া...খুবই কঠিন। বিভীষিকাময় সময় কেটেছে আমার। তবে শেষমেশ আমি স্নাতক শেষ করতে পেরেছি।
প্রথম আলো :
তারপর কোথায় জয়েন করলেন?
২০১৫ সালের জুলাইয়ে আমার স্নাতক শেষ হয়। আমার শিক্ষকেরা বললেন আড়ং, ইয়েলো বা বেক্সিমকোতে জয়েন করতে। তাঁরা রেফার করবেন। কিন্তু আমার মনে হলো, আমি আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। ডিজাইনার হিসেবে নিজেকে এক্সপ্লোর করতে চাই। আর আমি একটু ‘এক্সক্লুসিভ’ কাজ করতে চাইতাম। শুরু থেকেই আমি কাজের মানে কোনো ছাড় দিইনি। যখন যেটা করেছি, নিজের সবটা ঢেলে করেছি। তখন আমার পছন্দের ডিজাইনার ছিলেন রিনা লতিফ ও হুমায়রা খান। আমি দুজনকেই নক করলাম। হুমায়রা খান আমাকে ডাকলেন। এক বছর তাঁর সঙ্গে ‘আনোখি’তে কাজ করলাম। বছরখানেক পর মনে হলো, না, যেটা করতে চাচ্ছি, এটা সেটা নয়। তারপর ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করলাম। টিভিসি, মিউজিক ভিডিওর কাজ করলাম, ইউনিলিভারের হয়ে কিছু কাজ করলাম, ফ্যাশন ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করলাম। ২০১৬–এর মাঝামাঝি থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এ রকম কিছু কাজ করলাম। এরপর ‘লেবেল ইমাম হাসান’ নামের কাস্টমাইজড পোশাক বানিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করলাম। তখন থেকেই আমার কাপড়, পোশাক সবাই পছন্দ করত। তখন থেকেই ফ্রেন্ডশিপের (এনজিও) সঙ্গে কাজ শুরু। ওরা তখন চরের মেয়েদের উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। ওদের প্রথম কালেকশনটার ফটোশুটে আমি ফ্যাশন স্টাইলিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করলাম। এরপর ফ্রেন্ডশিপের ডিজাইনার হিসেবে জয়েন করি। এখন আমি ওদের প্রধান ডিজাইনার। আমার একটা বড় টিম আছে। গত বছর ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি)-এর সদস্য হলাম।
প্রথম আলো :
লকডাউনের সময়টা কীভাবে কেটেছে?
আমার আসলে ভালোই কেটেছে। ওই সময় আমি বাংলাদেশের গ্যেটে ইনস্টিটিউট আর জার্মানির উইবেনজে কুনশস্কুল বার্লিন (Weißensee Kunsthochschule Berlin) বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা স্কলারশিপ পাই। বাসায় থেকেই চার মাসের একটা কোর্স করি। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ওপর। টেকসই ফ্যাশন নিয়ে। আমার সঙ্গে পাকিস্তান, ভারত, রোমানিয়া, জার্মানিসহ আরও আট-দশটা দেশের ফ্যাশন ডিজাইনাররা কোর্সটা করেছিলেন। অনেক কিছু শিখেছি। ডিজাইন করেছি। ভাবনার সময় পেয়েছি।
প্রথম আলো :
২০২৪ এর জানুয়ারির ‘খাদি’র শোতে আপনার সংগ্রহ বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। কোন বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন?
আমি শুরু থেকেই স্লো ফ্যাশন, টেকসই ফ্যাশন আন্দোলনে বিশ্বাসী। খাদিতে আমার সংগ্রহের অনুপ্রেরণা ছিল প্রকৃতি। এ কারণেই সবুজের, চোখে আরাম দেয় এ রকম একটা শেড নিয়ে কাজ করেছি। মাটির রং নিয়েছি। খাদির সুতা, কাপড় সবই তো হাতে তৈরি। কোনো মেশিনের স্পর্শ ছাড়া। কোনো এনার্জি খরচ বা অপচয় না করেই। আমি এই সংগ্রহে থার্টিজের ফ্যাশনের সঙ্গে আধুনিকতাকে জুড়েছি। ওই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক কারণে একটা ফ্যাশন ডিপ্রেশন চলছিল। সেই সঙ্গে হলিউডের ফ্যাশনের দাপট বাড়ছিল। আমি সে ড্রামাটা আমার কাজে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। চওড়া স্লিভ, চওড়া নেকলাইন...
ওই ১৬টা পোশাকের ভেতর আপনার কোনটা পছন্দ?
মায়ের কাছে প্রিয় সন্তানের কথা জানতে চাইলে যেমন লাগে, আমার এখন তেমনটাই লাগছে...তবে শাড়িটা আমার কাছে বিশেষ। পাতাগুলো হাতে জুড়ে জুড়ে একটা থ্রিডি লুক আনার চেষ্টা করেছি। আর স্কার্ট-টপটাও সবাই খুব পছন্দ করেছে।
প্রথম আলো :
এই পোশাকগুলো পরে কী হয়েছে?
পোশাকগুলো তো আসলে মডেলদের শরীর চিন্তা করে বানানো হয়, অনেকেই তাই সেগুলো কিনতে পারেন না। ফিট করবে না তো। শো শেষে দর্শকদের কয়েকজন কয়েকটা কিনে নিয়েছে। আর কিছু আছে এখনো।
প্রথম আলো :
খাদির আগে ২০২৩-এর শেষের দিকে যে ফ্যাশন শোটা হলো, আপনার ফ্যাশন কাউন্সিলের সদস্য হওয়ার পর প্রথম শো...ওখানেও তো আপনার ১৬টা কালেকশন ছিল। ওটার থিম কী ছিল?
হ্যাঁ। স্যালভেজিং আর্ট। পৃথিবী দূষণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ এই গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি। রং, মেডিসিন, শক্তির মাধ্যমে পানি, মাটি, বাতাসের দূষণ...আমার সংগ্রহে সে বিষয়টি উঠে এসেছে। ফাটা মাটির রং, টেক্সচার, নীল, দূষিত পানির রং, ইনডিগোর বিভিন্ন শেড...প্রকৃতি আহত হলে রং যেমন হয়, এ বিষয়টিই ছিল আমার অনুপ্রেরণা। কাপড় আর রং সেভাবে করা।
প্রথম আলো :
আপনার এই সংগ্রহটাই তো জাপানি শিল্পী ইয়ায়োই কুসামার কাজ থেকে অনুপ্রাণিত?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি এখানে ‘জিরো ওয়েস্ট ওয়ার্ডরোব’ করার চেষ্টা করেছি। প্যাচওয়ার্কের কাজ করেছি।
প্রথম আলো :
এর আগে আপনার ‘ডট জেনেসিস’ সংগ্রহটাও তো ইয়ায়োইয়ের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত?
হ্যাঁ। আর সেভেনটিজের স্টাইলকে হাইলাইট করেছি। ইয়ায়োইয়ের কাজ কিন্তু ডট দিয়েই। ওনার প্রচুর শিল্পকর্ম হয়েছে কেবল ডট দিয়ে। এটি ছিল আমার টেকনোর (টেকনো মোবাইল) শো। আমার প্রকৃতি নিয়ে কাজ করতে যেমন ভালো লাগে, সময় নিয়ে কাজ করতেও ভালো লাগে।
প্রথম আলো :
ফ্রেন্ডশিপের আউটলেট তো বনানীতে একটা আর ধানমন্ডিতে একটা?
হ্যাঁ। বাংলাদেশে এই দুইটি। আর লুক্সেমবার্গে একটি।
প্রথম আলো :
এখানে আপনার কাজটা কী?
চরের মেয়েরা কাপড় বানায়। আমি ওদেরকে আমার ভাবনাটা বুঝিয়ে দিই। ওরা সেই ম্যাজিকটা দেখায়। আমার ভাবনাটা যেটা কাগজে লেখা, সেটা আমার চোখের সামনে ঘটায়। দেশি হ্যান্ডলুম, দেশি টাইডাই, দেশীয় নানা শিল্পের এসব কাজ বিদেশিরা খুবই পছন্দ করে। এভাবে আমরা চরের নারীদের ক্ষমতায়ন করছি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশীয় ঐতিহ্য তুলে ধরছি। ফ্রেন্ডশিপে আমি ও আমার দল ২০২২ আর ২০২৩ সালে ‘আ নাইট অব ট্র্যাডিশন এক ও দুই’—এই দুটি শো করেছি।
জিরো ওয়েস্ট গার্মেন্টস বলতে কী বোঝায়?
এর মানে হলো যে কাপড়টি দিয়ে পোশাক বানানো হবে, সেটার কোনো টুকরা, কোনো সুতাও না ফেলে পুরোটা দিয়ে পোশাক বানানো। আমি কাজ করেছি জিরো ওয়েস্ট নিয়ে।
প্রথম আলো :
ফেলে দেওয়া কাপড় দিয়েও তো নানাকিছু তৈরি হয়?
ওটা, আপসাইকেল বা রিসাইকেল।
প্রথম আলো :
স্লো ফ্যাশন কী?
গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি যেটা করে, একসঙ্গে অনেক পোশাক বানায়, সেগুলো বানাতে অনেক এনার্জি খরচ হয়। অল্প সময়ে অনেক পিস গার্মেন্টস উৎপাদিত হয়। সেগুলো অল্প সময় ধরে ব্যবহার করা হয়। মেশিনের ব্যবহার হয়। যেমন টি-শার্ট, পোলো টি-শার্ট, শার্ট এ রকম আর কী। অন্যদিকে স্লো ফ্যাশনে পোশাকটি হাতে বানানো হয়। সময় বেশি লাগে। অল্প পরিমাণে উৎপাদিত হয়। এনার্জির অপচয় হয় না। আর ব্যবহারকারী অনেক দিন ধরে ব্যবহার করে। যেমন আমাদের জামদানি, যশোরের নকশিকাঁথা—এগুলো স্লো ফ্যাশন মুভমেন্ট।
প্রথম আলো :
টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব যে ভারত নিবন্ধন করল, এটাতে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
খুবই দুঃখ পেলাম। ভারত তো অনেক বড় একটা দেশ। ওদের নিজস্ব ভৌগোলিক পণ্যের অভাব নেই। এর আগে জামদানি নিয়ে একটা টানাহেঁচড়া হয়েছে। এবার টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে শুরু হলো। আমি বুঝিনি, আমরা কেন হাত গুটিয়ে বসে আছি। আমি অপেক্ষা করছি, এটা বাংলাদেশের হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে, সেই খবর শুনব।
প্রথম আলো :
সামনে কী করবেন?
পড়াশোনা। বিবি আপা যেটা বলেছিলেন, সেটা করব। লন্ডন, নিউইয়র্ক বা প্যারিস—ফ্যাশনের এ তিনটি ‘রাজধানী’র যেকোনো একটি জায়গায় পড়তে যাব। তারপর যেখানেই থাকি দেশের মাটি, পানি, নদী, প্রকৃতি, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকেই আমার কাজের ভেতর দিয়ে তুলে ধরব।
প্রথম আলো :
দেশে আপনার পছন্দের কয়েকটা ফ্যাশন ব্র্যান্ডের নাম বলেন?
আমি আড়ংকে নিয়ে খুবই গর্বিত। নতুন ব্র্যান্ডগুলোর ভেতর কিউরিয়াসের কাপড়, ডিজাইন আমার ভালো লাগে। এ ছাড়া নতুনদের ভেতর আফসানা ফেরদৌসি ভালো করছে। আর বিবি রাসেল, চন্দ্রশেখর সাহা, মাহিন খান—তাঁরা তো আছেনই।
প্রথম আলো :
আপনি তো কাস্টমাইজড করে বিয়ের পোশাকও বানান?
হ্যাঁ। তবে খুবই কম। অনেকেই আমাকে বিয়ের জন্য লেহেঙ্গা বানাতে বলে। স্যাম্পল হিসেবে পাঠিয়ে দেয় ভারতের নামকরা ডিজাইনারদের লেহেঙ্গা। ফলে কাজগুলো আর করা হয় না। ডিজাইনার হয়ে যদি আমি নকলই করব, তাহলে তো আমার এত সংগ্রাম করে, চ্যালেঞ্জ নিয়ে স্নাতক পাস করার দরকার ছিল না! তবে আমার এক বান্ধবী একবার আমাকে দিয়ে বিয়ের জন্য সাদা জামদানি করাল। অর্পিতা। ও এখন লন্ডনে থাকে। ওর শাশুড়ি তো প্রতিবেশী দেশে চলেই গেছে বিয়ের শপিং করতে। শেষমেশ ও বিয়েতে সাদা জামদানি পরেছিল। ওর শাশুড়ি শুরুতে রাগ হয়েছিল। পরে ওকে বিয়ের আসরে দেখে বলে কী, ‘তোমাকে তো একটা পরির বাচ্চার মতো সুন্দর দেখাচ্ছে।’ অর্পিতা আর ওর শাশুড়ি দুজনই আমার কাছ থেকে পরে বেশ কিছু শাড়ি করেছে। আসলে ফ্যাশনে এখন এই আধিপত্য থেকে সরে আসাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।