পূজার শাড়িতে দেশি আলপনা আর ফুল
পীযুষ কান্তি সরকার বড় হয়েছেন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার পাটুরিয়া গ্রামে। ছোটবেলা থেকে পৌষপার্বণে দেখতেন, ঘরের সদ্য লেপা আঙিনা আর দেয়াল সেজে উঠত নানা আলপনায়। মাঝখানে থাকত পদ্ম। সেই পদ্ম আবার সত্যিকারের পদ্ম নয়, একটা শুভসূচনার আনন্দময় ইঙ্গিত বোঝানো হতো সেই আলপনা দিয়ে। সেই পদ্মের চারপাশ দিয়ে থাকত লাঙল, কাঁচি, কলকের নকশা।
একেক উৎসবে একেক থিমের আলপনা আঁকা হতো। লক্ষ্মীপূজায় থাকত ধানের ছড়া আর পায়ের আকৃতির আলপনা। পীযুষের মা চালের গুঁড়া দিয়ে খুব ভালো আলপনা আঁকতেন। এ জন্য আশপাশের গ্রাম থেকেও উৎসবে আলপনা আঁকতে তাঁকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হতো। গ্রামে যাঁরা আলপনা ভালো আঁকতেন, তাঁদের সবাইকে ডেকে এনে আঁকাআঁকির কাজে যুক্ত করা হতো। বিয়েতে বরের পিঁড়িতে আবার একধরনের আলপনা আঁকা হতো। এই যে একেকটা আলপনার একেক মানে, এসবই খুব টানত পীযুষকে। আলপনার মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে যে আন্তরিকতা, শিল্পীমনের প্রকাশ, সেটি খুব ভালো লাগত পীযুষের। পড়াশোনার সময়েই তাই বেছে নিলেন নিজের পছন্দের বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে পড়লেন ডিজাইন অ্যান্ড পেইন্টিং নিয়ে।
পীযুষ পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন ২০০৩ সালে। তারপর ঢাকার এক স্কুলে শুরু করেন শিক্ষকতা। শিশুদের আঁকাআঁকি শেখাতে ভালো লাগত তাঁর। তবু নিজে যে আলপনা করছেন না, ছবি আঁকছেন না, এ নিয়ে মনে একটা দুঃখবোধ লেপ্টে থাকত। এরই মধ্যে ২০০৮ সালে তাঁর মা মারা গেলেন। তারপর ২০১৮ সাল থেকে পীযুষ বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে দেশি শাড়িতে আলপনা আঁকতে শুরু করেন। তিনি কেবল সেসব আলপনাই আঁকতেন, যেগুলোর একটা সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আছে; ছোটবেলা থেকে যে আলপনাগুলো দেখে তিনি শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। শহরে তো মাটির ঘর নেই। আলপনার সংস্কৃতি অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু ছোটবেলার স্মৃতিজাগানিয়া সেই আলপনাগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে পীযুষ ক্যানভাস হিসেবে বেছে নিলেন শাড়ির আঁচল ও পাড়।
শাড়িতে আলপনা ছাড়াও নানান ফুল আঁকেন পীযুষ। দেশি ফুলগুলো মানুষের কাছে পরিচিত করতেই শাড়িতে দেশি ফুল আঁকার এই ভাবনা এসেছে তাঁর মাথায়। পীযুষের মতে, পোশাক কেবল পরিধানের নয়, সেটা শেখার মাধ্যমও হয়ে উঠতে পারে। পোশাকে আঁকা ফুল দেখে যাঁরা পোশাকগুলো গায়ে চড়াচ্ছেন, তাঁরা যেমন ফুলগুলোর নাম জানছেন, তেমনি তাঁদের পরিচিতজনদেরও নামগুলো বলতে পারছেন বলেই মনে করেন পীযুষ। তিনি বলেন, ‘শাড়িতে একটা ফুল দেখে কেউ হয়তো সেটার নাম জানতে চাইবে। অপরাজিতা, নয়নতারা, সন্ধ্যামালতী, জুঁই, চামেলি, বকুল, পারুল—আমাদের দেশের ফুলগুলো যেমন সুন্দর, ফুলের নামগুলোও। আমি চাই, এই ফুলগুলো মানুষ চিনুক, নামগুলো জানুক। তাহলেই আমার ভালো লাগবে। কেউ যখন দেশি ফুলের নাম চেনে, আমি খুশি হয়ে যাই।’