তরুণেরা আমাদের বিস্মিত করেছে
কয়েক দিনের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল। আন্দোলন হলো। আন্দোলনে হামলা হলো। হামলার প্রতিবাদে সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সম্পদ নষ্ট হলো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মাঠে সেনা নামল। শিক্ষার্থীদের শরীর ও মন ক্ষতবিক্ষত হলো। অনেক তাজা প্রাণ আমরা হারালাম। বাংলাদেশে কোনো আন্দোলনে এর আগে একসঙ্গে এত প্রাণ আমাদের হারাতে হয়নি।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছে, এভাবে তো আমরা দাবি আদায় করতে চাইনি। দেশের মানুষ বলছে, আর নয়, আর একটি প্রাণেও যাতে আঘাত না আসে। এমন অবস্থায়ও কঠোর ভূমিকায় সরকার। সরকার পতনের আশায় বিরোধী দল। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা বলছে, পড়তে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছে, ক্যাম্পাস খুলে দাও। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে কেউ ঠিকমতো কিছু বলছে না। ইন্টারনেট সীমিত; শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো তথ্য পাচ্ছে না। আমরা শিক্ষকেরা বিমূঢ়, স্তম্ভিত। অপেক্ষা করছি, এরপরে আর কী দেখতে হবে! দেশ এখন সুস্থ নেই। তাই দেশের মানুষ ভালো নেই। এভাবে ভালো থাকা যায় না।
আমাদের আগের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিল। আশা করেছিল, অধিকার ফিরে পাবে মানুষ। সব অসাম্য দূর হবে। সেই উত্তরাধিকার নিয়ে আমাদের প্রজন্ম গর্বিত হলো। কিন্তু মানুষে মানুষে বৈষম্য আরও বেড়ে গেল। নতুন প্রজন্ম নতুন করে ভাবছে। তারা বৈষম্য আর দেখতে চায় না। দেশকে এগিয়ে নিতে চায়। অথচ তাদের নিয়ে আমাদের কত অভিযোগ ছিল। ওরা বই পড়ে না। ওরা ডিভাইসে আসক্ত। ওরা রাজনীতি-সচেতন না। ওদের হাতে বাংলাদেশ ভালো থাকবে না।
সব ভুল ওরা ভেঙে দিয়েছে। আমাদের বিস্মিত করেছে। কীভাবে এক হতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয়, ওরা দেখিয়েছে। ওরা প্রমাণ রেখেছে, ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দেশ বড়, দেশের মানুষ বড়। ওরা বলেছে, কোনো পক্ষের দাবার ঘুঁটি ওরা হবে না। এই তরুণেরা আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। ওরা রাজনীতি বোঝে না। কিন্তু বুঝিয়েছে, ভবিষ্যতের রাজনীতি ওদের হাতে নিরাপদ। ওরা রূপকথার গল্প শুনে বড় হয়নি। তবু রূপকথার দৈত্য-দানোদের ওরা চেনে।
আমাদের ব্যর্থতা, আমরা এই বাংলাদেশকে ওদের উপযোগী করে রাখতে পারিনি। খেলার মাঠ রাখিনি। সাঁতরানোর নদী রাখিনি। বেড়ে ওঠার কোনো সুযোগ রাখিনি। অথচ ওরা বড় হয়েছে সব বাধাকে পেরিয়ে। তাই কোনো বাধা ওদের কাছে বাধা নয়। ওরা জন্মেই দেখেছে সবখানে আলো নেই। হাঁটতে গিয়ে দেখেছে সব পথ সমতল নয়। বিশ্বাস করতে গিয়ে দেখেছে সব কথা সত্য নয়। তাই এই প্রজন্ম নিজেরা কাঁধে তুলে নিয়েছে দায়িত্ব—বাংলাদেশকে আলোয় ভরে তোলার, পথ সমান করার, আর সত্য খোঁজার।
অনেক পাপ আমাদের জমেছে। অনেক দায় আমাদের রয়েছে। এখন সময় এসেছে পাপ মোচনের, দায় মেটানোর। আমরা, মানে আমাদের প্রজন্ম আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে করেছিলাম, সন্তানের পড়াশোনার জন্য এ দেশ নয়। বসবাসের জন্য এ দেশ নয়। এ দেশে কাজ নেই। মেধার মূল্যায়ন নেই। দলবাজি ছাড়া বুঝি সুযোগ মেলে না। আমরা এসব ভেবেছি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখিনি, দেশটাকে বদলানোর উপায় ছিল। সেই উপায়কে আমরা কাজে লাগাইনি। কিন্তু তরুণেরা দেখিয়েছে, দেশটাকে বদলানো সম্ভব। ওরা এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে।
সবাই জানে, কখনো তারুণ্য পরাজিত হয়নি। কখনো শুভবোধ পরাজিত হয়নি। কোনো আঁধার চিরদিন পৃথিবীকে ঢেকে রাখে না। কোনো অন্যায় কখনো ন্যায়কে হারাতে পারে না। তাই আসুন, আশা না হারাই। তরুণদের কাজের জায়গা করে দিই। শিশুদের আনন্দের ভুবন তৈরি করি। নিজেদের কাজে সৎ থাকি। দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়। দায়িত্ব সবার। সবাই নিজের নিজের কাজ সুন্দর করে করি। তাহলেই সুন্দর হবে বাংলাদেশ।
অর্থনীতি কতটুকু এগোল আর কতটুকু ভগ্ন হলো, এ হিসাব কোনো কাজে আসবে না। এ হিসাবে বাংলাদেশকে সুন্দর করা যাবে না। যে অর্থনীতি বিভাজন বাড়ায়, সে অর্থনীতি আমরা চাই না। যে উন্নয়ন শুভবোধকে পাশ কাটায়, সেই উন্নয়ন আমরা চাই না। আমরা উন্নতি চাইব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর। উন্নতি চাইব সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। উন্নতি চাইব মনুষ্যত্বের—যাতে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব হয়, কুণ্ঠা না হয়। আমরা হৃদয়ের বিশালতা খুঁজব। প্রমাণ দেব নিজের হৃদয়ের বিশালতার। আমরা আর বিভাজনের মধ্য দিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নিতে চাই না।
আমরা শক্তি অর্জন করব, কিন্তু সেই শক্তি যেন দুর্বলকে আঘাত করার কাজে না লাগাই। একইভাবে বলব, যার শক্তি আছে সে যেন দুর্বলকে আঘাত না করে। কারণ, আঘাতে আঘাতে দুর্বলও শক্তি অর্জন করে। তারপর একসময় ঠিক প্রত্যাঘাত করে। এই আঘাত-প্রত্যাঘাতে সমাধান আসে না। মনুষ্যত্বের জয় হয় না। ঐক্য নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। ঐক্যেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা আর তোমরা—স্বাধীন দেশে এখন আর এই বিভাজন থাকতে পারে না।
সবাই জানে, সময় থেমে থাকে না। বর্তমানের সময়গুলো মুহূর্তে মুহূর্তে অতীত হতে থাকে। সেই অতীতের কোনো কোনো অংশ ইতিহাস হয়। এই ইতিহাসে হয়তো সবার ঠাঁই হয় না। কিন্তু ইতিহাসের পরিণতি সবাইকে ভোগ করতে হয়।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়