যেখানে ফ্ল্যাট কিনলে বাড়ির পাশেই পাবেন খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার...
নগরজীবনে বসবাসের সুবিধা আনেক। সেই সুবিধাকে আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দেয় কন্ডোমিনিয়াম। যেখানে এক আবাসিক এলাকার মধ্যেই মেলে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা। কাছেই খোলা মাঠ, ব্যায়ামাগার, সুপারশপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিং মল, পার্ক, উপাসনালয়সহ নানা কিছু। দিন দিন তাই জনপ্রিয় হচ্ছে আবাসন প্রতিষ্ঠানের গড়া কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্প। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার তেমনই কয়েকটি প্রকল্প ঘুরে এসে লিখেছেন শুভংকর কর্মকার
ঢাকার গুলশানের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকরি করেন সঞ্জয় সাহা। থাকেন ভাড়া বাসায়। অনেক দিন ধরে পরিকল্পনা করছেন, নিজের সঞ্চয় আর ব্যাংকঋণ নিয়ে ছোটখাটো একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনবেন। কয়েকটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণাধীন প্রকল্প ঘুরেও দেখেছেন। তবে ব্যাটে–বলে হচ্ছিল না। সময়ও গড়ায়। ছেলে–মেয়ে দুটি বড় হচ্ছে!
হঠাৎ একদিন সঞ্জয় সাহা খেয়াল করেন, সারা দিন বদ্ধ জায়গায় থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠছে তাঁর দুই সন্তান। মুটিয়েও গেছে খানিকটা। মেজাজও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণ ঝগড়াঝাঁটি করে। তখন সঞ্জয়ের মাথায় নতুন চিন্তা আসে। অ্যাপার্টমেন্টের আয়তন ছোট হলেও খোলামেলা পরিবেশ আছে, এমন প্রকল্পেই নিজেদের ফ্ল্যাট কিনবেন। কোমর বেঁধে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলেন। শেষ পর্যন্ত নতুনবাজার এলাকায় একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের কন্ডোমিনিয়াম আবাসন প্রকল্পে মনের মতো ফ্ল্যাট পেলেন। খোঁজখবর নিয়ে বুকিং দিলেন।
সঞ্জয় সাহা বলেন, বারিধারার এই কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্পে বাচ্চাদের খেলার জায়গা, হাঁটার জায়গা, ব্যায়ামাগার, পার্টি সেন্টার, গাড়ি পার্কিংসহ নানা সুযোগ–সুবিধা রয়েছে। সেখানে একসঙ্গে অনেক পরিবার বসবাস করবে। ফলে বাচ্চারা একটি সুন্দর সামাজিক পরিবেশের মধ্যে বড় হওয়ার সুযোগ পাবে।
সঞ্জয় সাহার মতো অনেকের কাছেই কন্ডোমিনিয়াম আবাসন প্রকল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তার বড় কারণ, সাধারণ আবাসন প্রকল্পের তুলনায় কন্ডোমিনিয়ামে বাড়তি সুযোগ–সুবিধা থাকে। দামও তেমন বেশি নয়। কারণ, বড় জায়গায় প্রকল্প করলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নিয়ম অনুযায়ী যতটুকু জায়গা ছাড়তে হয়, সেটুকুতেই বাচ্চাদের খেলার মাঠ, হাঁটার জায়গা, ব্যায়ামাগার, সুইমিংপুল, সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত করা যায়।
ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্প আছে। সেসব দেশে অভিজাত কন্ডোমিনিয়াম যেমন আছে, তেমনি মধ্যবিত্তের জন্যও কন্ডোমিনিয়াম আছে। স্থানীয় মানুষের চাহিদা অনুযায়ী একেক দেশে একেক রকম প্রকল্প হয়। সুযোগ-সুবিধাও কিছুটা ভিন্ন হয়। তেমনি বাংলাদেশেও মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে এ ধরনের প্রকল্প হাতে নিচ্ছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। মূল ঢাকার পাশাপাশি আশপাশের এলাকায়ও হচ্ছে কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্প।
গত দুই দশকে বেশ কিছু কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্প হয়েছে ঢাকায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খিলক্ষেতে ‘লেক সিটি কনকর্ড’, মিরপুর মাজার রোডে ‘শেল্টেক্ বীথিকা’, বনশ্রীতে শান্তা হোল্ডিংসের ‘দ্য ভিনটেজ’, মহাখালীতে ‘শেল ছায়ানীড়’, মিরপুরে ‘বিজয় রাকিন সিটি’ ইত্যাদি। বর্তমানে উত্তরা, মিরপুর, বনশ্রী, মোহাম্মদপুর, মগবাজার ও লালমাটিয়ায় কন্ডোমিনিয়াম আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করছে রূপায়ন সিটি উত্তরা, নাভানা রিয়েল এস্টেট, এবিসি রিয়েল এস্টেটস, ট্রপিক্যাল হোমস লিমিটেডসহ কিছু প্রতিষ্ঠান।
দুই প্রকল্পে দুই চক্কর
১২০ ফুট প্রশস্ত ঝকঝকে সড়ক। দুই পাশ ও মাঝখানের সড়কদ্বীপে পাম, খেজুরসহ নানা প্রজাতির গাছ। ফুটপাতে গাছের নিচে বসার জায়গা। সড়কবাতিগুলোও দৃষ্টিনন্দন। মনোরম এই পরিবেশেই গড়ে উঠছে সারি সারি ভবন। রাজধানী ঢাকার উত্তরায় ১৩৪ বিঘা জমির ওপর এমনই একটি আধুনিক শহর গড়ে তুলছে রূপায়ন গ্রুপ।
রূপায়ন সিটি উত্তরায় চারটি ফেজ বা পর্যায় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটি আবাসিক ও একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প। আবাসিকের মধ্যে দুটি পর্যায়ে রয়েছে ‘গ্র্যান্ড’ ও ‘ম্যাজিস্টিক’ নামে প্রিমিয়াম মানের কন্ডোমিনিয়াম। অন্যটি স্কাই ভিলা, যা মূলত ডুপ্লেক্স (দ্বিতল) অ্যাপার্টমেন্ট। সব কটি ভবনই একটি বেজমেন্টসহ ৯ তলা।
ম্যাজিস্টিক কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্পে ১১টি ভবনে ৩১৫টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। ১ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ১০০ বর্গফুট আয়তনের এসব অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের জন্য দুটি কমিউনিটি হল, বাচ্চাদের খেলার মাঠ, বাস্কেটবল খেলার কোর্ট, নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা ব্যায়ামাগার এবং একটি মসজিদ রয়েছে। ইতিমধ্যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এখানে কার্যক্রম শুরু করেছে। স্কুল চত্বরে ছোট্ট খেলার মাঠও আছে।
অন্যদিকে গ্র্যান্ড কন্ডোমিনিয়ামে ২৫টি ভবনে ৫৭৭টি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। ২ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার ১০০ বর্গফুট আয়তনের এসব অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদের জন্য সুইমিংপুল, দুটি কমিউনিটি হল, বাচ্চাদের খেলার মাঠ, বাস্কেটবল কোর্ট, নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা ব্যায়ামাগার এবং একটি মসজিদ থাকবে। এ পর্যায়ের বাসিন্দাদের শিশুদের জন্যও আলাদা একটি স্কুল থাকবে। স্কাই ভিলা পর্যায়েও আলাদা সুযোগ–সুবিধা থাকবে। ফলে কোনো পর্যায়ের বাসিন্দাদের অন্য পর্যায়ে যেতে হবে না।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের রূপায়ন সিটি উত্তরা ঘুরিয়ে দেখান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা আবির বিশ্বাস। তিনি জানান, পুরো প্রকল্পের ৬৩ শতাংশ জায়গা ফাঁকা, অর্থাৎ সেখানে কোনো স্থাপনা নেই। এর মধ্যে ৪২ শতাংশে থাকবে গাছপালা। প্রকল্পের ভেতরে সব মিলিয়ে থাকছে সাড়ে ছয় কিলোমিটার হাঁটার জায়গা। এ ছাড়া পুরো প্রকল্পের বাসিন্দাদের জন্য একটি ভবনে সুপারশপ, ফার্মেসি, চিকিৎসকের চেম্বার ও লন্ড্রি–সুবিধা চালু হবে।
ইতিমধ্যে ম্যাজিস্টিক কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্পের অ্যাপার্টমেন্ট বুঝিয়ে দিয়েছে রূপায়ন সিটি কর্তৃপক্ষ। ১৩৭টি পরিবার বসবাস শুরু করছে সেখানে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, মাঝখানে খেলার মাঠ, বসার জায়গা আর বাস্কেটবল খেলার জায়গার তিন পাশে ১১টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সব অ্যাপার্টমেন্টেই পর্যাপ্ত আলো–বাতাস পাওয়া যায়। ভবনের বেজমেন্টে রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। আর নিচতলায় ব্যায়ামাগার ও অভ্যর্থনাকেন্দ্র। এক পাশের সব কটি ভবনের বেজমেন্ট একসঙ্গে হওয়ায় নিচতলার বেশির ভাগ জায়গা খোলামেলা।
রূপায়ন সিটি উত্তরার গ্রাহক সেবা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক জিয়াদুর রশীদ বলেন, পুরো প্রকল্পের জন্য তিন স্তরের নিরাপত্তা রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট স্টিকার ব্যতীত বা পূর্ব অনুমতি ছাড়া কোনো গাড়ি প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না। আবার বাসিন্দাদের জন্য মূল ফটক পর্যন্ত শাটল সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসসহ যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হয়।
রূপায়ন সিটি উত্তরার মতো সব কন্ডোমিনিয়ামে অবশ্য একই রকম সুবিধা মেলে না। প্রকল্পভেদে কম-বেশি হয়। রূপায়ন সিটি ঘুরে আমরা মিরপুরের বিজয় রাকিন সিটিতে যাই। ৫০ বিঘা জমির ওপর এই কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্পে ৩৬টি ভবনে ১ হাজার ৯৫০টি অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে তোলা হয়েছে।
মূল ফটক দিয়ে প্রকল্পে প্রবেশ করলেই ৬০ ফুট প্রশস্ত সড়ক। দুই পাশে সারি সারি ১৪ তলা ভবন। বাচ্চাদের খেলার জন্য ছোট পাঁচটি খেলার জায়গা রয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি ব্লকে একটি করে কমিউনিটি হল আছে। পুরো প্রকল্পের সীমানাদেয়ালের পাশ দিয়ে হাঁটার জায়গা রয়েছে। মূল ফটকের এক পাশে রয়েছে মসজিদ। আলাদা একটি ভবনে সুপারশপসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য দোকানপাট রয়েছে।
২০১৪ সালে বিজয় রাকিন সিটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৮ সাল থেকে অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর শুরু হয়। তবে পুরো প্রকল্পে সবুজের বড্ড অভাব। কয়েক হাজার বাসিন্দার জন্য একটি সুইমিংপুল থাকলেও মনে হলো অনেক দিন তা ব্যবহার করা হয় না।
অবশ্য রাকিন ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির কর্মকর্তা মো. রাহিদ আলম বলেন, শীতের সময় সুইমিংপুল বন্ধ থাকে। অন্য সময় এখানে সাঁতার শেখে এখানকার বাচ্চারা। সড়কের দুই পাশে গাছ লাগানো হবে। এ ছাড়া একটি কমিউনিটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে ক্লাব, ব্যায়ামাগার, মেডিকেল সেন্টার ও একটি সুইমিংপুল হবে।
এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ‘আমাদের দেশের আবাসন খাতে কন্ডোমিনিয়াম আবাসন প্রকল্প তুলনামূলক নতুন ধারণা। এসব প্রকল্পে নিরপত্তা ও খেলার মাঠসহ অন্য সুযোগ–সুবিধা থাকায় মানুষের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্পে বসবাসের জন্য উন্নত পরিবেশ পাওয়া যায় বলেই সেটিকে নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায়ও (ড্যাপ) উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ড্যাপে এলাকাভেদে ভবনের উচ্চতা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে রাজউক। যদিও বড় আয়তনের জমিতে কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্পের জন্য ভবনের উচ্চতায় ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর ফলে আগামী দিনে ঢাকা ও এর আশপাশে এবং অন্যান্য বড় শহরে নতুন নতুন কন্ডোমিনিয়াম প্রকল্প হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’