ডাকছে শরৎ

শরতের সঙ্গে স্নিগ্ধতার সম্পর্ক চিরায়ত। শরৎ শব্দটি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে আকাশের সাদা-নীল, ধবধবে সাদা কাশফুলে আর শিউলি ফুলের সাদা, কমলা রঙে। এই তো শরতের চিহ্ন, বিশেষ করে এখনকার নগর ও নেট জীবনে। শরৎ যে এসে গেছে, তার জানান দেয় ভার্চ্যুয়াল জগৎ। আর বাস্তব জগৎ তো আছেই।

শরতের স্নিগ্ধতা ফুটে ওঠে কাশফুলের শুভ্রতায়।মডেল: তটিনী, পোশাক: আর্ট অব ব্লু, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: সুমন ইউসুফ

হাস্যোজ্জ্বল মুখের দুপাশে কাশফুলের ডাঁটা। বাতাসে দোল খাচ্ছে কাশফুল। পরনে নীল শাড়ি, সাদা ব্লাউজ কিংবা নীল-সাদার অন্য কোনো পোশাক। সঙ্গে অবশ্যই টিপ। ছেলেদের পরনে নীল পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা। এই সময়ে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতায় পাতায় এমন ছবি ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। যেমন নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা।

কাশফুল, কাশবনের ল্যান্ডস্কেপে ছবি তুলতে যায় অসংখ্য মানুষ
মডেল: তটিনী, পোশাক: আর্ট অব ব্লু, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: সুমন ইউসুফ

শরৎ যে এসে গেছে, এভাবেই তার জানান দিচ্ছে ভার্চ্যুয়াল জগৎ। আর বাস্তব জগতেও একটু খেয়াল করলে আশপাশেই পেয়ে যাবেন শরতের চিহ্ন। উত্তরে রাজধানীর দিয়াবাড়ীর পাশ দিয়ে যদি যাওয়া পড়ে কিংবা দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জ—বিস্তীর্ণ জায়গা ধরে কাশবন চোখে পড়বে অনিবার্য। বালু–মাটি দিয়ে ভরাট কোনো আবাসন প্রকল্প, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার চর—পুরো দেশজুড়েই তো এখন কাশফুল, কাশবনের ল্যান্ডস্কেপ। আবার ঢাকার চলতি পথে ঘাড় উঁচিয়ে কোনো বহুতল ভবনে একেবারে ওপরে তাকালে ছাদের রেলিং টপকে উঁকি মারা কাশফুল চোখে পড়বে। অনেকেই এ সময় ছাদবাগানের টবে লাগিয়ে রাখেন কাশফুল। অনেক উঁচুতে সেগুলো ছড়ায় শুভ্রতা।

শরতের সঙ্গে স্নিগ্ধতার যে সম্পর্ক, তা চিরায়ত। রবীন্দ্রনাথের গানে যেমন বিদেশিনীকে শারদপ্রাতে...দেখার মুগ্ধতা দেখা যায়, তেমনি শরৎ শব্দটি স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে সাদা-নীল, শিউলি ফুলের সাদা ও উজ্জ্বল কমলা রঙে। শরৎ তো এভাবেই উদ্‌যাপিত হয় বাঙালির দিনযাপনে।

আরাম দেবে সুতির পোশাক
মডেল: তটিনী, পোশাক: আর্ট অব ব্লু, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: সুমন ইউসুফ

নিজের মধ্যেও শরতের স্নিগ্ধতা ধরে রাখতে আরামের পোশাক পরাই ভালো। আরামের বেলায় সেরা হলো সুতি। জানালেন ডিজাইনার ও ফ্যাশন হাউস দেশালের ভাইস চেয়ারপারসন ইশরাত জাহান। তিনি বললেন, ‘শরতের পোশাকে এই সময়ের প্রকৃতির রং উঠে এলে সবচেয়ে ভালো হয়। যেমন নীল, সাদার সমন্বয় হতে পারে। প্যাস্টেলজাতীয় রংগুলো বেশ ভালো দেখায় এ সময়। আবার শিউলির বোঁটার যে অদ্ভুত সুন্দর একটা কমলা রং আছে, সেটিও পোশাকে ফুটিয়ে তুলতে পারলে অসাধারণ লাগে।’ পোশাকের উপকরণ হিসেবে সুতিই এগিয়ে আছে এই ডিজাইনারের কাছে।

সার্বিকভাবে শরতে কোন রঙের পোশাক বেশি কেনেন ক্রেতারা, জানতে চাইলাম ইশরাতের কাছে। বললেন, ‘শরতে হালকা রঙের পোশাক বিক্রি হয়। নানা শেডের নীল-সবুজের সমন্বয়ে তৈরি পোশাকগুলো বেশি চলে। এককথায় বলা চলে, প্যাস্টেল ধারার রংগুলো। এর বাইরে সাদা ও উজ্জ্বল কমলা তো আছে।’

শরৎকালে আছে এক বড় পার্বণ। বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব, দুর্গাপূজা। শরৎকালে পূজা, তাই এর নাম শারদীয় দুর্গাপূজা। ঢাকে কাঠি পড়তেই আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে শরৎ। শরৎ উদ্‌যাপনে এই উৎসব যোগ করে আনন্দের বাড়তি মাত্রা। যেহেতু উৎসব, ফ্যাশন বাজারেও তার প্রভাব পড়ে। বেড়ে যায় কেনাকাটা। তবে তাতে শুধু শরতের প্রকৃতির রংই থাকে না; বরং উৎসবের রংগুলোর প্রাধান্যও চোখে পড়ে।

নীল রঙের পোশাক যেন এ সময়েই বেশি মানায়
মডেল: তটিনী, পোশাক: আর্ট অব ব্লু, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: সুমন ইউসুফ

নগরজীবনে প্রকৃতির সব ঋতুর ছোঁয়া অন্দরেও এসে পড়ে। বসার ঘরের খাটো টেবিলে ছড়ানো পাত্রে পানির ওপর যদি ভাসতে থাকে শিউলি ফুল, তবে তা কার না নজর কাড়বে। ঘরেই তৈরি হবে শরতের আবহ, ঘরের বাসিন্দা আর ঘরে আসা অতিথি—দুইয়েই মন ভালো হয়ে উঠবে। ছাদবাগানে কিংবা যদি থাকে এক টুকরা উঠান, তবে হাফ ড্রাম বা একচিলতে মাটিতে স্থান করে নিতে পারে শিউলিগাছ। গাছে থাকা কিংবা সকাল-সন্ধ্যা গাছতলায় ঝরে পড়া শিউলি মনকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দেবে। বড় বড় ফুলদানিতে যদি রাখা যায় লম্বা ডাঁটাসমেত কাশফুল, তবে মনে হবে এক টুকরা ‘দিয়াবাড়ী’ই যেন বাড়িতে উঠে এসেছে।

কাশ, শিউলি ছাড়াও এ সময় প্রকৃতিতে দেখা যায় আরও কিছু স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল ফুল। কৃষিবিদ ও লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায়ের কাছে একটা তালিকাও পাওয়া গেল। এই সময়ের ফুল হলো সাদা টগর। পদ্ম-শাপলা বর্ষার ফুল, তবু শরতের কিছু অংশে এই দুই জলজ সুন্দরীর দেখা পাওয়া যায়। পদ্মপুকুর কিংবা লাল শাপলার জলাশয় তো এখন রীতিমতো দর্শনীয় স্থান। শরতের পুষ্পতালিকায় আছে অলকানন্দা (নগর নার্সারিতে যা অ্যালামন্ডা)। হলুদ, সাদা, লাল, গোলাপি, কালচে–লাল—নানা রঙের অলকানন্দা তার নামের মতোই সুন্দর। টবে পর্যাপ্ত পানি দিলেই ফুলের পর ফুল ফুটিয়ে বাগানির জন্য প্রতিটি দিনকেই করে তোলে আনন্দময়। উজ্জ্বল হলুদরঙা সোনাপাতি শরতের আরেক ফুল। আরও আছে নীল বনলতা। অন্য রকম এক নীলরঙা ফুল শরতে দেখা যায় বাংলার প্রকৃতিতে।

শরতের প্রকৃতি, শরতের আবহাওয়া প্রতিটি দিনেই এনে দিতে পারে একটু আনন্দ।
মডেল: তটিনী, পোশাক: আর্ট অব ব্লু, সাজ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: সুমন ইউসুফ

শরৎ কেন স্নিগ্ধ? একটু শুনে আসি মৃত্যুঞ্জয় রায়ের কাছে, ‘বর্ষার পর আসে শরৎ। বর্ষার বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতিতে গাছপালায় পরিবর্তন দেখা যায়। বর্ষার পানিতে প্রকৃতি সতেজ হয়ে ওঠে। সেই সতেজ ভাব শরৎকালেও থাকে। গাছপালা আর প্রকৃতিকে বেশি তরতাজা দেখা যায়।’

এই তরতাজা সতেজ ভাবটাই হয়ে উঠতে পারে উদ্‌যাপনের অনুষঙ্গ। শরতের প্রকৃতি, শরতের আবহাওয়া প্রতিটি দিনে এনে দিতে পারে স্নিগ্ধতা, একটু একটু আনন্দ। আজ বা কাল—কোনো এক শারদপ্রাতে ঘাসে থাকা হালকা শিশিরে পা ভিজিয়ে, স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে মনে একটু স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লাগিয়ে শরতের উদ্‌যাপন ভালোভাবেই করা যায়।