পতাকাটা মেলে ধরতেই ৩২০ কিলোমিটার বেগে ছোটা একটি বুনো ঘোড়ায় পরিণত হলো
বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়তে ৪২ হাজার ফুটের বেশি উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন আশিক চৌধুরী। আশিকের সেই প্রচেষ্টাকে এবার স্বীকৃতি দিল গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। ১ জুলাই ‘গ্রেটেস্ট ডিসট্যান্স ফ্রিফল উইথ আ ব্যানার/ফ্ল্যাগ’ শাখায় ভারতের জিতিনের জায়গায় তারা অন্তর্ভুক্ত করল আশিকের নাম। রেকর্ড গড়া সেই ঝাঁপের গল্প শোনালেন আশিক চৌধুরী
আমার হাতের হিটেড গ্লাভস উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। গ্লাভস পরা সেই হাতে শক্ত করে ধরে আছি লাল–সবুজ পতাকা। উত্তেজনার চোটে কখন যে ৪১ হাজার ফুট পার হয়ে গেছি, খেয়ালই করিনি। জাম্প মাস্টার পল গলসন তখনই সংকেত দিলেন, ‘থার্টি সেকেন্ডস টু এক্সিট।’ মানে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমাকে ঝাঁপ দিতে হবে। শেষবারের মতো অক্সিজেন সাপ্লাই আর থার্মাল স্যুটের হিট সেন্সরগুলো কাজ করছে কি না, চেক করে নিলাম। স্কাইডাইভিংয়ের রীতি মেনে ফ্লাইট ক্রুর সঙ্গে বিদায়ী করমর্দন করলাম। কে জানে এটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা।
প্লেনের দরজা খোলা হলো। সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরে ঢুকে পড়ল একখণ্ড মেঘ। ভেতরটা ধোঁয়াটে হয়ে গেল। দরজার দিকে যেতে যেতে জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। পৃথিবীটা আসলেই গোল কি না, সেটিই দেখার চেষ্টা। বাইরে তাকাতেই চোখে পানি চলে এল। কী অদ্ভুত সৌন্দর্য। মনে হলো মাসের পর মাস এত যে খাটাখাটনি, তা বৃথা যায়নি। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ মনে হলো। হলফ করে বলতে পারি, পুরো জাম্পে ওই মুহূর্তটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দময়।
দরজার কাছে যেতে যেতে আগের রাতে দেখা একটি দুঃস্বপ্ন মনে পড়ে গেল—আমি দরজার কাছে যাচ্ছি, হঠাৎ পতাকাটা আমার হাত ফসকে উড়ে গেল। শুরুর আগেই বানচাল হয়ে গেল পুরো উদ্যোগ! সেই দুঃস্বপ্নের ভয়েই কিনা জানি না, পতাকাটা সাবধানে বুকের কাছে চেপে দরজা পর্যন্ত গেলাম। শেষবারের মতো আমার শারীরিক ও মানসিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো মনিটরে চেক করল গলসন। গত বছর এ রকমই একটি ঝাঁপের ঠিক আগে—সেটা অবশ্য ট্রায়াল জাম্প ছিল, বিকল হয়ে যায় এক স্কাইডাইভারের হৃৎপিণ্ড। প্লেন অবতরণ করতে করতে তিনি মারা যান।
এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই থাম্বস আপ করল পল। সঙ্গে সঙ্গে বড় একটি শ্বাস নিয়ে ৪২ হাজার ফুট (প্রায় ১৩ কিলোমিটার) উচ্চতা থেকে শূন্যে এক পা বাড়ালাম। দিনটা ছিল ২৫ মে। যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসের স্থানীয় সময় তখন সকাল ৮টা ১৭ মিনিট।
বুনো ঘোড়াকে সামলানোর চেষ্টা
পুরো পতনটায় (ফ্রিফল) সময় লাগার কথা বড়জোর তিন মিনিট। অনেক ভেবেছি—এই তিন মিনিট আসলে কী চিন্তা করে কাটাব। দোয়া-দরুদ থেকে শুরু করে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা—অনেক কিছুই পরিকল্পনায় ছিল; কিন্তু লাফ দিয়েই বুঝলাম, আর দশটা ঝাঁপের মতো এটা না। এত উঁচুতে বাতাস না থাকার কারণে মনে হচ্ছে, কাচের স্বচ্ছ পাহাড় বেয়ে পিছলে পড়ে যাচ্ছি। যে পতাকা এই ঝাঁপ–পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু, সেটিকে মেলে ধরতেই ৩২০ কিলোমিটার বেগে ছোটা একটি বুনো ঘোড়ায় পরিণত হলো। একদিকে আমি পতাকাটাকে ধরে রাখার প্রাণান্ত যুদ্ধ করে চলছি, অন্যদিকে সে আমাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পতাকাটা হাতে না থাকলে এই স্কাইডাইভ অনেক সহজ হতো। এত বড় আকারের পতাকা নিয়ে আগে কেউ যেহেতু একা ঝাঁপ দেয়নি, তাই ঠিক কী কী চ্যালেঞ্জে পড়তে পারি, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। স্কাইডাইভিংয়ে সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত হচ্ছে আনকন্ট্রোলড স্পিন (অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘুরতে থাকা)। পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী একবার ফ্যানের পাখার মতো ঘোরা শুরু করলে এই গতি বাড়তেই থাকবে। যার পরিণতি হতে পারে প্রাণঘাতী। ভারসাম্য বজায় রাখতে পতাকার বিপরীত দিকে বল তৈরির সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি।
যা হওয়ার হবে, পতাকা ছাড়া যাবে না
মিনিটখানেকের মাথায় চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করলাম। দ্রুত বাতাসের চাপ বাড়ার কারণে কানে প্রচণ্ড ব্যথা বোধ হতে লাগল। আপনা–আপনিই আমার মধ্যে টিকে থাকার প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিল। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, পতাকাটা ছেড়ে দিই। তাহলে হয়তো বেঁচে যাব। আবার মনে হচ্ছিল, এ ধরনের সুযোগ তো একবারই পাওয়া যায়। আরেকটু চেষ্টা করি। ঝাঁপটা দেশের জন্য না হয়ে ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য হলে এ পর্যায়ে আমি হয়তো রণে ভঙ্গ দিতাম। তখনই ফ্ল্যাশব্যাকের মতো স্ত্রী, সন্তান আর মা-বাবার কথা মনে হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম, যা হওয়ার হবে, পতাকা ছাড়া যাবে না।
শেষ দিকে শরীরে একবিন্দু শক্তিও বাকি ছিল না। প্রায় জ্ঞান হারানোর দশা। ফ্যানের পাখার মতো ঘুরছি। ঘোরার কারণে প্যারাস্যুটের হাতল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক যুদ্ধ করে প্যারাসুট খোলার পর দেখি, সব দড়ি পাকিয়ে আছে। এ অবস্থায় প্যারাস্যুট নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। একটার পর একটা ইমার্জেন্সি কোনোরকমে সামলে সামনে তাকিয়ে দেখি, ল্যান্ডিং জোন তখনো বহু দূর! বিদ্যুতের তার নেই, এমন জমি খুঁজে বের করতে হলো। তারপর কোনোরকমে মাটিতে আছড়ে পড়লাম।
অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন মাটিতে নামার পর আমার অনুভূতি কী ছিল। সত্যি বলতে, গর্ববোধ ও আনন্দ ছাপিয়ে তখন আমার একমাত্র অনুভূতি ছিল—স্বস্তি।
দেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ
ছোটবেলায় গ্রিক পুরাণের ইকারুসের গল্প পড়েছিলাম। পাখির পালক দিয়ে ডানা বানিয়ে সে উড়তে শিখেছিল। সেই থেকে আমার স্বপ্ন ছিল, পাখির মতো উড়ব। সংসার, ক্যারিয়ার, আর্থিক সক্ষমতা—সব সমীকরণ মেলাতে সময় লেগেছে; কিন্তু স্বপ্নটাকে বিসর্জন দিইনি। ব্যস্ততা ও বয়সের অজুহাত তৈরি করা যায়। কিন্তু আমি মনে করি দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থাকলে একজন ক্যারিয়ারমুখী দায়িত্বশীল বাবাও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী হতে পারে। গত বছর স্কাইডাইভিং লাইসেন্স নিলাম। আমার জাম্পস্যুটে বাংলাদেশের পতাকা দেখে স্কাইডাইভ ট্রেনিং স্কুলে অনেকেই জিজ্ঞাসা করে, এটা কোন দেশের পতাকা। সেখান থেকেই প্রথমে মাথায় আসে দেশের পতাকা নিয়ে কিছু একটা করব। দেশটা আমাদের। বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে আমাদেরই প্রমাণ করতে হবে যে আমরাও কোনো অংশে কম নই। দেশের নাম উজ্জ্বল করতে যার যার জায়গা থেকে সে সে চেষ্টা করবে। এটা আমার চেষ্টা। আশা করি, আমার এই চেষ্টা দুঃসাহসিক সব স্বপ্ন দেখতে আর বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহ জোগাবে।
পুনশ্চ: কিছু মানুষ আর প্রতিষ্ঠানের সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই এই উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হতো না। সবার নাম লেখা দুষ্কর। প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইউসিবি, প্রথম আলো, আমার স্ত্রী নন্দিনী, আমার মা-বাবা, প্রমি, প্রয়াত শাশুড়ি সংগীতা খান, মেজ মামা, দ্রাবিড় ভাই, মামা-খালা, কাছের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর দেশের মানুষের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।