যেভাবে মা–বাবার সঙ্গে সুভাষের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিলেন বাংলাদেশের শামসুল হুদা
মানুষটা হিন্দিভাষী। কথা অস্পষ্ট, জড়ানো। রংপুরের বদরগঞ্জে কীভাবে এলেন, জানেন না। নাম–ঠিকানা জানতে চাইলে শুধু বলেন, ‘সুভাষ, রামনগর।’ জায়গাটা কোথায়? খোঁজ করেন শামসুল হুদা। প্রযুক্তি আর মানুষের সহায়তায় পেয়েও যান। শুধু জায়গাটা নয়, সুভাষের পরিবারকেও খুঁজে বের করেন তিনি। শামসুল হুদার কাছে রোমাঞ্চকর সেই গল্পটা শুনলেন সজীব মিয়া
বদরগঞ্জে অসহায় মানুষদের একটা ঠিকানা আছে। পথেঘাটে, স্টেশনে পড়ে থাকা অসহায় অসুস্থদের আশ্রয় এই ঠিকানা। সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানটার নাম গ্লোরি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। রংপুরে নিজের এলাকায় এমন একটি সংস্থা কাজ করছে, জেনে দেখতে গিয়েছিলেন বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের জ্যেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক শামসুল হুদা। ভেবেছিলেন, কোনোভাবে যদি পাশে থাকা যায়।
এই বছরেরই ১২ মে বদরগঞ্জে গ্লোরি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় গিয়ে দেখতে পান, পাকা একটা ঘরে ১৬ জন নারী থাকেন। কেউ কথা বলতে পারেন, কিন্তু ঠিকানা জানেন না। কেউ রোগেশোকে, কেউ আবার বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আরেকটি কক্ষে আছে চারজন পুরুষ। সবার সঙ্গেই কথা বলেন শামসুল হুদা। সেখানেই এক তরুণকে দেখতে পান। বয়স ২৮ কি ৩০ বছর। তাঁর নাম সুভাষ। গত বছর জুনে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছে। আহত অবস্থায় পড়েছিলেন তিনি। এক রিকশাচালক ডিমলা থানায় পৌঁছে দেন। কোমরের হাড় ভাঙা ছিল। নড়তে–চড়তে পারছিলেন না। অবস্থা গুরুতর দেখে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। নিউরোসার্জারি বিভাগে তিন মাসের বেশি চিকিৎসা চলে। চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দেয়। কিন্তু কোথায় যাবেন সুভাষ? হাসপাতালের বারান্দাতেই কাটতে থাকে তাঁর দিন–রাত। তারপর রংপুরের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে গ্লোরি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় ঠাঁই পান সুভাষ। গত ৩০ অক্টোবর থেকে সেখানেই আছেন তিনি।
সুভাষের সঙ্গে কথা বলে শামসুল হুদা জানতে পারেন, তাঁর বাড়ি ভারতের রামনগর। জায়গাটা কোন শহর বা রাজ্যে, তা বলতে পারেন না সুভাষ।
রামনগরকান্ডার খোঁজে
সুভাষের সঙ্গে কথা বলার মুহূর্তটা ভিডিও করে এনেছিলেন শামসুল হুদা। ঢাকায় ফিরে ভিডিওটা দেখেন তিনি। এলাকার নামটা ভালোভাবে শোনেন। বুঝতে পারেন, শুধু রামনগর নয়, শব্দটা রামনগরকান্ডা।
চিত্রগ্রাহক পরিচয়ের বাইরে শামসুল হুদার আরেকটা পরিচয় আছে। বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও সোসাইটির তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক। সেই সূত্রে অ্যামেচার রেডিওর সদস্যদের প্ল্যাটফর্ম থেকে কলকাতার এক সদস্যের নম্বর সংগ্রহ করেন শামসুল হুদা। যোগাযোগ করে তাঁকে সুভাষ সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন। ভিডিওটাও পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এত বড় ভারতে শুধু রামনগরকান্ডা নামে কীভাবে খুঁজে বের করবেন তিনি। জানিয়ে দেন, ব্যাপারটা অসম্ভব। বৃথা চেষ্টা।
দিনে দিনে পেশাগত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শামসুল হুদা। অনেকটা ভুলেও যান সুভাষের কথা।
ভরসা গুগল ম্যাপ
২ আগস্ট ২০২২। শামসুল হুদার পরিবার রংপুরে বেড়াতে গেছে। ঢাকায় একা হুদা। রাতে সন্তানের কথা মনে পড়ে। একসময় সুভাষের কথাও মনে পড়ে যায়। একদিন মেয়েকে না দেখেই যে খারাপ লাগছে, না জানি সুভাষের মা-বাবার কী অবস্থা। বিছানা থেকে উঠে বসেন শামসুল হুদা। সুভাষের ভিডিওটা আবার দেখেন। জায়গার নাম শোনেন। ল্যাপটপ অন করে বসে পড়েন। গুগল ম্যাপে ‘রামনগরকান্ডা’ লিখে সার্চ দেন। ম্যাপ তাঁকে নিয়ে যায় ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের নেপাল সীমান্তবর্তী একটা এলাকায়। শামসুল হুদার চোখমুখ আনন্দে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। গুগল ম্যাপে ডুবে যান তিনি। খুঁজে দেখেন বাহরাইচ জেলার অংশ রামনগরকান্ডা। উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের এলাকা।
মানুষকে খুঁজে পাওয়ার সহজ মাধ্যম প্রশাসন। বাহরাইচ জেলার সরকারি ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারেন শামসুল হুদা। এলাকা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। তেমন কিছু জানতে পারেন না। তবে পুলিশ সুপারের নম্বরটা পেয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেন। সুভাষের ছবি পাঠিয়ে বিষয়টি জানান।
অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে না।
সাড়া না পেয়ে বিকল্প পথ খোঁজেন শামসুল হুদা। লক্ষ্ণৌতে অ্যামেচার রেডিওর কোনো সদস্য পাওয়া যায় কি না, খোঁজ করেন। দীনেশচন্দ্র পণ্ডিত শর্মা নামে একজনকে পেয়েও যান। তাঁকেও বিষয়টি জানান।
ফেলুদা পড়ে বড় হয়েছেন শামসুল হুদা। রাতদুপুরে নিজেকে গোয়েন্দা ভেবে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন। বারবার মোবাইল হাতে নিয়ে দেখেন কোনো উত্তর আসে কি না। রাতটা নির্ঘুমই কেটে যায়।
অপেক্ষা দীর্ঘ হয়
সকাল সকাল পুলিশ সুপারের নম্বরে কল করেন শামসুল হুদা। হোয়াটসঅ্যাপে যা লিখেছিলেন, পুলিশ কর্মকর্তাকে আবার সেসব বলেন। সাতসকালেই শামসুল হুদার কলটা যে তাঁর ভালো লাগেনি, আলাপে তা স্পষ্ট হয়। তারপরও পুলিশকর্তা জানান, বিষয়টি তিনি দেখবেন।
পুলিশের সঙ্গে আলাপ শেষে দীনেশচন্দ্র পণ্ডিতকে কল দেন শামসুল হুদা। দীনেশ জানান, তিনি চেষ্টা করছেন। স্থানীয় একজন সাংবাদিককে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছেন। বিকেল নাগাদ ফলাফল জানা যাবে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। উত্তেজনা চেপে অপেক্ষা করতে থাকেন শামসুল হুদা।
৩ আগস্ট, বিকেল। দীনেশকে আবার কল করেন শামসুল হুদা। কিন্তু তখনো স্থানীয় সাংবাদিকের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাননি বলে জানান তিনি। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। দীনেশ কল করেন জানান, সাংবাদিকের মাধ্যমে স্থানীয় পঞ্চায়েতপ্রধানের নম্বর পেয়েছেন তিনি। শামসুল হুদা নম্বরটা নিয়ে নেন। রোজকার কাজে সে দিনটা কেটে যায়। পঞ্চায়েতপ্রধানের সঙ্গে সেদিন আর কথা বলা হয় না।
পরদিন ৪ আগস্ট সুবেদারকে কল দেন। রামনগরকান্ডার নিধিপুরওয়া গ্রামের সদ্য বিদায়ী পঞ্চায়েতপ্রধানের নাম সুবেদার। নামের আগেপিছে নিশ্চয় বংশপদবি আছে, সেটা জানা হয় না। হিন্দি জানার সুফলটা এভাবে পাবেন শামসুল হুদা বুঝতে পারেননি। সুভাষের কথা বলতেই চিনে ফেলেন সুবেদার। জানান, তাঁর বাড়ির কাছেই সুভাষদের বাড়ি। প্রায় ১৬ মাস আগে ছেলেটা হারিয়ে গেছে।
সুবেদার তখন বাড়ি থেকে দূরে কোথাও ছিলেন। শামসুল হুদার কাছে আধঘণ্টা সময় চেয়ে নেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করে দেবেন জানিয়ে সংযোগ কেটে দেন।
১৬ মাস পর কথা
ঠিক আধঘণ্টা পর শামসুল হুদার মুঠোফোন বেজে ওঠে। পঞ্চায়েতপ্রধান সুবেদারের ভিডিও কল। দেখেন বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে সুবেদার। এঁরা সবাই সুভাষের পরিবারের সদস্য। একে একে পরিচয় করিয়ে দেন বাবা লক্ষ্মণ প্রসাদ, মা সুনীতা ও বোন অঞ্জনির সঙ্গে।
শামসুল হুদা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, এমন একটা কিছু ঘটতে চলেছে। গ্লোরি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার প্রধানকে আগেভাগেই কথাটা জানিয়ে রেখে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। প্রাথমিক আলাপ শেষে ভিডিও কনফারেন্সে সুভাষকে যুক্ত করেন শামসুল হুদা।
ফ্যালফ্যাল করে মা-বাবার দিকে চেয়ে থাকেন সুভাষ। অপর প্রান্ত থেকে ছেলেকে দেখে কাঁদতে থাকেন তাঁর মা, বাবা, বোন। এটা-ওটা জিজ্ঞেস করেন। সুভাষ কোনোটার উত্তর দেন, কোনোটা চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দেন। সে এক আবেগঘন মুহূর্ত।
সুভাষ কবে ফিরবেন
পরিবারের সঙ্গে এখন প্রায়ই কথা হয় সুভাষের। তাঁর মধ্যে চঞ্চলতা ফিরে এসেছে। ওদিকে সুভাষকে ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে তাঁর পরিবার। বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদও প্রচারিত হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সুভাষ মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। চিকিৎসকের পরামর্শও নেওয়া হয়েছিল। তারপর একদিন বাড়ি থেকে নাই হয়ে যায় তাঁদের ছেলে। কিন্তু কীভাবে কখন ভারত থেকে বাংলাদেশে পৌঁছাল, কেউ তা জানে না। যেমন জানে না কোমরটা কীভাবে ভাঙল। দরিদ্র পরিবারটা এখন ছেলেকে ফিরে পেতে চায়।
শামসুল হুদাও চেষ্টা করছেন। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনকে চিঠি লিখেছেন তিনি। লক্ষ্ণৌর সাংবাদিকেরাও তৎপর হয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগী হওয়ার জন্য বলেছেন তাঁরা। শামসুল হুদা আশা করেন, সুভাষকে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া দ্রুতই সম্পন্ন হবে।