হাসপাতালে গিয়ে জানলাম সাপটি বিষধর
নিজের পাটখেতে নিড়াচ্ছিলেন জাহিদ প্রামাণিক। সেখানেই তাঁকে ছোবল দেয় একটা সাপ। তারপর? রাজবাড়ীর এই তরুণ কৃষকের মুখ থেকে পুরো ঘটনা শুনলেন তৌহিদী হাসান
এক বিঘা জমিতে পাট করেছি এবার। ঈদের আগে খেতে গিয়ে দেখি খুব আগাছা হয়েছে। কয়েক দিন ঘাস কাটব কাটব করেও কাজটা আর করা হয় নাই। তাই সোমবার (৩ জুলাই) সকাল সকাল ঘাস কাটতে যাই।
দূর্বার মধ্যে নিড়ানি চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও আটটার মধ্যেই অনেকখানি নিড়ানি হয়ে যায়। কড়া রোদে ঘামতে ঘামতেই কাজ করতে থাকি। এমন সময় মনে হলো, ডান হাতের বুড়া আঙুলে কিছু একটা কামড় দিল। ভাবলাম, রক্তচোষা হবে। কিন্তু না, দেখি ছোট একটা সাপ। কামড়টা কে দিছে, বুঝতে আর বাকি থাকে না। ভয়ে কাঁচি দিয়ে দিলাম একটা কোপ। সাপটা তখনই মরে যায়।
পাশের খেতেই কাজ করছিল আমার চাচাতো ভাই আমির প্রামাণিক। ডাক শুনে সে ছুটে এল। কুষ্টা (পাটের আঁশ) দিয়ে সে আমার ডান হাত শক্ত করে বেঁধে দিল। তখনো আমার মধ্যে খুব একটা ভয়ডর কাজ করছিল না।
শুনেছি, ছোবল দেওয়া সাপ চিকিৎসকরে দেখালে ওষুধ দিতে সুবিধা হয়। তাই মরা সাপটা কুষ্টা দিয়ে বেঁধে পলিথিনে ভরে নিলাম। এই সাপ আমার অচেনা, জীবনে প্রথম দেখেছি!
খেত থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। বাড়িতে আসার পর সাপে কামড়েছে শুনে সবাই খুব চিন্তায় পড়ে যায়। আশপাশের অনেকেই চলে আসলেন। কিন্তু সাপ দেখে কেউ চিনলেন না। বাঁধা থাকার কারণে হাত ঝিনঝিন করতে শুরু হয়েছে। আঙুলও ফুলে উঠেছে। সামান্য রক্তও বের হলো। আব্বা পাংশা সদর হাসপাতালে যেতে বললেন। সঙ্গে অনেকেই যেতে চাইলেন। ১৫ মিনিটের পথ। তাই একাই টেম্পোতে চলে গেলাম।
চিকিৎসক সাহেব আমাকে দেখেই বললেন, ‘এখানে ওষুধ নাই, এখনই কুষ্টিয়ায় চলে যাও।’ একটা স্লিপও লিখে দিলেন।
কুষ্টিয়ায় যাব, কাউকে জানাতেও পারছি না। মুঠোফোনটা বাড়িতে রেখে আসছি। এক ভ্যানওয়ালাকে বাড়িতে খবর দিতে বলে মাইলখানেক দূরে গিয়ে কুষ্টিয়ার বাসে চড়ি। হাতে মরা সাপভরা পলিথিন। বাসে আমার পাশের সিটে কেউ ছিল না। এক ঘণ্টা পর কুষ্টিয়া বাস টার্মিনালে আসি।
ততক্ষণে শরীরটা খারাপ লাগা শুরু করেছে। আমার মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। ভ্যানওয়ালা বাড়িতে খবর দিয়েছে কি না কে জানে।
বাস টার্মিনাল থেকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল দেড় কিলোমিটার। ইজিবাইকে সেখানে গিয়ে চিকিৎসকরে সাপটা দেখাই। দেখেই তিনি চিনে ফেলেন, এটা রাসেলস ভাইপার।
সাপে কাটলে কী করবেন
সাপে কাটা স্থানে একটি বা দুটি ক্ষতচিহ্ন, কাটা জায়গায় তীব্র ব্যথা বা জ্বালা, কাটা স্থান ফুলে লাল হয়ে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, ঘুমঘুম ভাব, মাথাব্যথা বা মাথা ঝিমঝিম, বমি বমি ভাব বা রক্তবমি, দুর্বলতা, দৃষ্টিভ্রম ও শ্বাসকষ্ট থাকলে বুঝতে হবে বিষধর সাপে কেটেছে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে শুইয়ে দিয়ে যেখানে সাপ কামড়েছে, তা সম্পূর্ণ স্থির রাখতে হবে। হাতে-পায়ে দংশনের ক্ষেত্রে একটি মোটা কাপড় বা গামছা দিয়ে দংশিত স্থানের ওপরে যেন খুব শক্ত না হয়, এমনভাবে গিঁট দিন। দংশিত স্থানের আশপাশে কাটাকাটি, সুই ফোটানো, রক্ত চুষে বের করা, গাছপালার রস বা গোবর লাগানো অনুচিত। সম্ভব হলে সাপটি দেখতে কেমন, তা লক্ষ করুন। সাপের বর্ণনা চিকিৎসককে সঠিক চিকিৎসা দিতে সাহায্য করবে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সাপে কাটা রোগীকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
জলদি আমাকে ভর্তি করে নিলেন। চিকিৎসক-নার্সদের ব্যস্ততা দেখে বুঝতে পারি, এটা খুব বিষধর সাপ। দুপুরেই আমাকে ইনজেকশন দেয়। নিজেকে খুব একলা মনে হতে থাকে। মা, বাবা, বউ, ছেলেমেয়ে হয়তো জানেও না যে আমি কুষ্টিয়ায়। ভয় করছিল। চিকিৎসক আর নার্সরা সাহস দেন।
হঠাৎই এলাকার এক পরিচিত লোককে পেয়ে যাই। তাঁকে ডেকে বাড়ির পাশের একজনকে ফোন করি। সে আমাদের বাড়িতে খবর দেয়। বিকেল চারটা নাগাদ বড় ভাই হাসপাতালে চলে আসে।
রাতটা চিন্তায় চিন্তায় কেটে যায়।
পরের দিন সকালেই মা, বাবা, বউ, ছেলেমেয়েরা চলে আসে। তাদের দেখে মনে সাহস পাই। শরীরও ভালো লাগতে থাকে। ধীরে ধীরে হাতের ঝিনঝিন ভাবও কমে যায়। তবে কিছুটা ফোলা থাকে। দিনে–রাতে তিনবেলা বড় বড় চিকিৎসক দেখতে আসেন। নানা কথা বলেন। তাঁদের কথায় জানতে পারি, সাপটা ছোট হলেও খুবই বিষধর।
চার দিন হাসপাতালে ছিলাম। চিকিৎসকেরা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন। তাঁরা যখন মনে করেছেন, আমি সুস্থ, তখনই বিদায় দিয়েছেন। তবে বলেছেন, কয়েক মাস আমাকে ফলোআপে থাকতে হবে। কিছুদিন বিশ্রামে থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার বাড়িতে ফিরে বিশ্রামেই আছি।