কালচার শক কী, কেন হয়, কীভাবে এড়াবেন
জীবনের আবর্তনে কখনো না কখনো পার হতে হয় নিজ সংস্কৃতির গণ্ডি। কাজের সুবাদে বা ঘুরতে যেতে হয় নতুন কোনো দেশে। নতুন দেশে যাওয়ার পর সেই দেশের সংস্কৃতির প্রভাবে ভিন্নতা বোধ হতেই পারে। এই অনুভবকে বলা হয় ‘কালচার শক’ বা ‘সংস্কৃতি অভিঘাত’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘প্রত্যেক মানুষই বেড়ে ওঠে নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। জন্মের পর থেকেই পরিবার ও সমাজ সেই সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে সহায়তা করে। তবে অনেক সময়ই নতুন দেশে ভ্রমণের ফলে সেখানকার রীতিনীতি আমাদের মধ্যে একধরনের কালচার শকের সৃষ্টি করে। কারণ, আপনি নিজের দেশে যেসব আচরণে অভ্যস্ত, অন্য দেশে সেটা ভিন্ন হওয়ায় মনে ঘা লাগতেই পারে বা অনভ্যস্ততা কাজ করতে পারে।’
কোথা থেকে এই কালচার শকের উৎপত্তি
১৯৫০-এর দশকে কানাডার নৃবিজ্ঞানী কালের্ভো ওবার্গ প্রথম ‘কালচার শক’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, এটি ধাপে ধাপে সংঘটিত প্রক্রিয়া। নিজ দেশের বাইরে কোথাও ঘুরতে গেলে ভ্রমণকারীরা শুরুর দিকে বেশ আনন্দ অনুভব করেন, যাকে ওবার্গ নাম দিয়েছেন ‘হানিমুন ফেজ’। এই ধাপ কাটিয়ে উঠলে ধীরে ধীরে নতুন সংস্কৃতির কিছু কিছু বিষয় তাঁদের গ্রহণ করতে কষ্ট হয়, এতে সৃষ্টি হয় হতাশা। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষ মানিয়ে নিতে সক্ষম হন, তবে কিছু বিরল ক্ষেত্রে এটি গুরুতর মানসিক সমস্যায় রূপ নিতে পারে। যার উদাহরণ হলো জেরুজালেম সিনড্রোম বা প্যারিস সিনড্রোম। ইসরায়েলের জেরুজালেম ঘুরতে গিয়ে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ ধর্মীয় বিভ্রম বা মানসিক বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়। আবার প্যারিসকে ধরা হয় প্রেম-ভালোবাসার শহর। তাই ভ্রমণকারীরা প্যারিসকে একটি রোমান্টিক শহর হিসেবে কল্পনা করেন, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন হওয়ায় অনেকে হতাশায় ভোগেন।
ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কালচার শক
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, মানুষের মূলত দুই ধরনের কালচার শক অনুভূত হতে পারে। একটি হলো, নতুন দেশে প্রথমবার যাওয়ার কারণে সেখানকার সংস্কৃতি আমাদের বিচলিত করতে পারে। আরেকটি হলো, নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য একটি দেশে বেশ কিছুদিন থাকার ফলে তাদের সংস্কৃতিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই। পরবর্তী সময়ে নিজ দেশে ফেরত এলেও বোধ হতে পারে কালচার শক অর্থাৎ নিজের সংস্কৃতির প্রতি অনভ্যস্ততা। যাকে বলা হয় রিভার্স কালচার শক।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একেক দেশের যোগাযোগের পদ্ধতি একেক রকম। পশ্চিমা বিশ্বে বুড়ো আঙুল উঁচু করে দেখানোকে সমর্থন করা বোঝালেও মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিস ও রাশিয়ায় তা নেতিবাচক হিসেবে ধরা হয়। তাই পশ্চিমা দেশের পর্যটক রাশিয়ায় গিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিপদেও পড়তে পারেন। খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতার কথা না বললেই নয়, বললেন অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন। একই মহাদেশের ভেতরে মসলাদার খাবারে অভ্যস্ত দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটক যদি পূর্ব এশিয়ার জাপানে বেড়াতে যান, সেখানকার খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগই পেতে হয়। এ ছাড়া কালচার শকেরই আরেক ধরন হলো ইকোনমিক শক। যেহেতু দেশভেদে মুদ্রামান ভিন্ন, তাই কম মুদ্রামানের দেশে গেলে আপনাকে হয়তো পানির বোতল কিনতেই গুনতে হতে পারে হাজারখানেক টাকা। যেমন বাংলাদেশি পর্যটকেরা ভিয়েতনামে গেলে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। মূলত নিজ সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে অন্য সংস্কৃতির যেসব অসামঞ্জস্যতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে, এমন সবই কালচার শকের অন্তর্ভুক্ত।
কীভাবে এড়াতে পারবেন কালচার শক
বছরের শেষ ভাগ এখন। অনেকেই ঘুরতে যাচ্ছেন নিজেদের পছন্দের গন্তব্যে, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। স্বভাবতই কালচার শকের মতো বিষয়ের মুখোমুখি হতে পারেন ভ্রমণপ্রেমীরা। কীভাবে এড়াতে পারবেন এ ধরনের পরিস্থিতি? তা নিয়েও কথা বললেন অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন।
বাস্তব প্রত্যাশা রাখুন: নতুন দেশে যাওয়ার আগেই আপনার গন্তব্য সম্পর্কে বাস্তব ধারণা নিয়ে নিন। যেন কম অপরিচিত বোধ হয়।
সংস্কৃতি গ্রহণ করুন: নতুন অভ্যাস ও সংস্কৃতি সহজভাবে গ্রহণ করুন এবং এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন।
প্রয়োজনে সাহায্য নিন: স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে মিশুন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করুন।
সময় দিন: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই সয়ে যায়। তাই নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় নিন।
দেশ-বিদেশ ভ্রমণ আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করারও একটি অন্যতম মাধ্যম। পূর্বপ্রস্তুতি ও নমনীয় মানসিকতা দিয়ে যেকোনো নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব। তাই কালচার শককে নেতিবাচকভাবে না দেখে এটি থেকে শিক্ষা নিন, জীবনের বৈচিত্র্য উপভোগ করুন, যা আপনার ভেতরে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে সাহায্য করবে।