রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে ভালোবাসতে শেখাল
৬ জুলাই ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহু তরুণের স্বপ্ন পূরণে পথ দেখিয়েছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনেকের হৃদয়ে নিশ্চয়ই একটা আলাদা জায়গা দখল করে আছে এই ক্যাম্পাস। তাঁদের প্রতিনিধি হয়ে লিখেছেন সুজন সুপান্থ
তরুণের দলে সবে নাম লিখিয়েছি। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এবার নতুন পাঠশালা। ঢাকায় পড়ার সুযোগ ছেড়ে, মা ছেড়ে, স্বজন ছেড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হয়েছে। এখানে অনেক বড় মাঠ, কত্ত বড় আকাশ! গ্রামের স্কুল-কলেজে উনিশ থেকে বিশ করলেই শিক্ষক, পাড়ার পরিচিতদের চোখরাঙানিসহ বাড়ির লোকেদের ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতে হতো। কিন্তু এখানে ওসব নেই; নিষেধ নেই, কারও চোখরাঙানি নেই। এখানে কেউ কাউকে চেনে না, আবার সবাই সবার পরিচিত। এখানে নিজেই নিজের দিকে চোখ রাঙাতে হয়। নইলে অসীম পথ চলে যেতে পারে উচ্ছন্নের দিকে।
হাত ধরে বহুদূরের অচেনা পথ পেরিয়ে বিশাল এই আকাশের নিচে পৌঁছে দিয়েছিলেন বড় ভাই। হাত ছেড়ে মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে দিয়ে বলেছিলেন—‘এই তোমার ঘর, ঘরের বাইরে ঘর। পেছনের মায়া ভোলো, পড়ো। বেশি কিছু দরকার নেই, বড় হওয়ার চেষ্টা করো।’
বিশাল ক্যাম্পাসের প্যারিস রোডে একা হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছিল, সন্ধ্যার আগে ভাইয়ের হাত ছেড়ে বান্নি মেলায় হারিয়ে গেছি। ঘরে ফেরার পথ আর জানা নেই। জিব-বুক ভারী হয়ে ওঠে, কান্না পায় ভীষণ। ইবলিস চত্বরের দিঘির কাছে দাঁড়িয়ে কান্না গিলে জোরে শ্বাস নিয়ে মনে করি—মমতাজ উদ্দিন কলাভবন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে কক্ষ নম্বর ৩০৩।
গ্রামে টিনের চালার স্কুল-কলেজের চালাটুকু ছিল শুধু। দেয়াল ছিল না, ছিল দরজার আদল। তার ফার্স্টবেঞ্চার আমি। কিন্তু এখানে ফার্স্ট বেঞ্চ ফাঁকা নেই। পরিচিত মুখ নেই। সবাই শুধু বলে, পেছনে যাও, এই দলে তুমি মিসফিট। তারা বোঝে শরতের মেঘ, বোঝে সোস্যাল রিয়েলিটি; অথচ বোঝে না আমার চোখ। পেছাতে পেছাতে প্রথমবারের মতো মিসফিট আমাকে ডেকে নেয় ব্যাক বেঞ্চ। মন নেই, মনোযোগ নেই, মনে নেই ক্লাস। বুঝতে পারি না কিছুই। কে বোঝাবে আমায়?
ক্লাস শেষে আমবন পেরিয়ে পশ্চিমপাড়ামুখী পথের ঝাকুমাকু জারুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হতে থাকে—অগুনতি মানুষ, অথচ চারপাশ কী নির্জন! আমি কারও কেউ নই, একদম একা। অচেনা ব্যথার মতো ভারী হয় বুক। ফেটে যেতে চায় চোখের মণি। মনে হতে থাকে, আকন্দ তুলার মতো শব্দ করে ফেটে হারিয়ে যাব আমবন-লিচুবন বা তুঁতবনের নির্জনে। পরে নিজেকে শান্ত করে ইবলিস চত্বরের দিঘির পাড়ে বসি। জলে ঢিল ছুড়ে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে মায়ের মুখ ভেবে মনে মনে বলি, ‘এই চোখে তোমার আঁচল বুলিয়ে দাও, মা।’ দেখি হাওয়া আসে, ঢেউ বাড়ে। দুলে ওঠে মধুকূপী ঘাস। হাওয়ায় আরাম লাগে চোখে। মায়া হয় জলে, মায়ায় ভেসে যায় প্যারিস রোড, ইবলিস চত্বর, পুরো চরাচর।
এর পর থেকে ঠিকানা হয়—৩০৩/৪০৬, ব্যাক বেঞ্চ। কোনো দিন পৃথিবীর কোথাও দেখা না হওয়া এই বেঞ্চের সহপাঠীদের পাশে পাওয়ার অনুভূতি বুঁদ করে রাখে। ধীরে বুঝতে পারি, এই ব্যাক বেঞ্চ আসলে এক জাদুর তাঁবু। প্রথম সারির বন্ধুরা যার দেখা কোনো দিন পায় না। কিন্তু শেষ সারি সুযোগ পেলে এই তাঁবু পেরিয়ে একদিন ফার্স্ট বেঞ্চেও বসতে পারে। তাই মনে মনে বলেছি, এই বেঞ্চে যারা আমায় আশ্রয় দিয়েছে, তাদের মন মধুময় হোক। যারা ফার্স্ট বেঞ্চ, পেছনে পাঠিয়েছে এই বন্ধুর কাছে, তারা আরও সহজ হোক; হোক আলোর সমান। এই ক্যাম্পাসেই জেনেছি, ব্যাকবেঞ্চারদের হৃদয় নদীর চেয়েও বড় হয়। তারাই বুনে দিতে পারে স্বপ্নের বীজ। আর আমি তো জানি, কেবল স্বপ্নই খুলে দিতে পারে চাবিহারানো যেকোনো জংধরা তালা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আমার জন্য দুয়ার খুলেছিল আগেই। ধীরে ধীরে সব আগলও খুলতে থাকে। সবকিছু ভালো লাগতে থাকে। ক্যাম্পাসকে মনে হতে থাকে নিভৃত বন্ধু, মনে মনে তার সঙ্গে অজস্র কথা বলা যায়। নিভৃত বন্ধুই শিখিয়েছে, নিজের ভেতরে তাকাও। এটা শিখতে পারলে জীবনের মঞ্চে প্রথম সারিতে দাঁড়ানো যাবে অনায়াসে। জারুলগাছ থেকে উড়ে যাওয়া পাখিদের দিকে তাকাও নিবিড়, দেখবে তার ডানার সঙ্গে তুমিও কেমন উড়ে যাচ্ছ দিকচক্রবালে। উড়তে না পারা মানুষের এ-ও কি বেশি পাওয়া নয়!
একদিন ওই নিভৃত বন্ধু বেঞ্চের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে ভালোবাসতে শেখায়। সবাই হাতে হাত রেখে জুড়ে যাই সবার সঙ্গে। যে বড় ভাই একা করে রেখে গিয়েছিলেন এই ঘরের বাইরের ঘরে, ধীরে ধীরে অনেকের মুখেই দেখি তাঁর মুখ। শিক্ষক-বিভাগের সিনিয়র এমনকি দিঘির জলের সামনে দাঁড়ালে নিজের ছায়ার মুখে দেখি জুড়ে আছে তাঁর মুখ। ওই মুখই পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় গন্তব্যের দিকে।
এখানে প্রতিদিন আনন্দে ভেসে চলা জীবন সত্য। পরের বেলায় কী খাব; মায়ের ছাগল ও বাবার জমি বিক্রি হয়নি, তাই টাকা আসতে দেরি হওয়ায় ব্যথিত অপমানের ক্লান্ত জীবনও সত্য। এর বাইরে আরও এক জীবন স্বচ্ছ নদীর মতো বয়ে চলে। সেখানেও রোদ ওঠে, চুলখোলা রোদ। এই রোদ পেরিয়ে এসে কাঁধ ছুঁয়ে যা আশ্রয় নিয়েছে, তার নাম প্রেম। ক্যাম্পাসের প্রেমই শিখিয়েছে, কী করে বিচ্ছেদের দূরত্ব অতিক্রম করে চলতে হয়। বিচ্ছেদ শিখিয়েছে ইবলিস চত্বরের আলামিন, লাইব্রেরি চত্বরের শিঙাড়াওয়ালা মানিকসহ ক্যাম্পাসের সবাই সবার স্বজন। আর জীবনের এই প্রথম প্রেম ও বিচ্ছেদ শিখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, নিভৃত বন্ধু।
সময় পেরিয়ে যায়। এই ঘর একদিন ছেড়ে দিতে হয়। ফেরার আগে আবারও ইবলিস চত্বরের দিঘির জলে ঢেউ দিয়েছি। জিবের ডগায় কান্না রেখে চুপিচুপি বলেছি—ও দিঘির জল, জুবেরি মাঠের নির্জন হাওয়া, গগণশিরীষগাছ, দূর্বা ও মধুকূপী ঘাস, প্রেমিকার হাসিমুখ, পশ্চিমপাড়ার কোলাহল, তুঁতবন ও জারুলের ফুল আমাকে পুরোটা নাও। নইলে আশীর্বাদ করো। এত দিন যার মাতৃভাবে দেওয়া শুশ্রূষায় বেড়ে উঠেছি, তার বিরহ নিয়ে যেন বড় হতে পারি। তারা আমায় আশীর্বাদ করেছে। বড় হওয়ার সেই চেষ্টা এখনো আয়ু পেয়ে যাচ্ছে।