লালবাগের হাম্মামখানা যেভাবে আদিরূপ ফিরে পেল

লালবাগ কেল্লার প্রধান তিনটি ভবনের একটি দরবার হল ও হাম্মামখানা। প্রায় তিন বছরের সংস্কার শেষে আদিরূপে ফিরেছে এই স্থাপনা। মোগল আমলের স্থাপনাটি কীভাবে আদি চেহারায় ফিরল, এই প্রকল্পের অন্যতম পরামর্শক স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর কাছ থেকে সেই গল্প শুনে অনুলিখন করলেন সজীব মিয়া

লালবাগ কেল্লার দরবার হল ও হাম্মামখানাছবি: স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর সৌজন্যে

প্রাচীন কোনো একটি ভবন সংস্কার বা পুনরুদ্ধার কাজে একজন সংরক্ষণ স্থপতির প্রথম কাজ হয় ভবনটিতে কী কী পরিবর্তন হয়েছে, তা খুঁজে বের করা। পরিবর্তনটা কখন, কীভাবে হয়েছে, সেটা বের করা। পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার দেওয়ান-ই-আম বা দরবার হল ও হাম্মামখানা সংস্কার বা পুনরুদ্ধারের কাজ করতে গিয়ে আমরা সে পথেই হেঁটেছি। সেই গল্পে যাওয়ার আগে কাজটি শুরুর প্রেক্ষাপট একটু বলা দরকার।

পাখির চোখে লালবাগ
ছবি: স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর সৌজন্যে

হাম্মামখানার দোতলায় ক্র্যাক বা ফাটল দেখা দিয়েছিল। সেটার সংস্কার করতে ‘রিস্টোরিং, রেেট্রাফিটিং অ্যান্ড থ্রি–ডি আর্কিটেকচারাল ডকুমেন্টেশন অব হিস্টোরিক্যাল মোগল হাম্মাম অব লালবাগ ফোর্ট’ নামে প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। প্রকল্প–প্রস্তাব তৈরি করে তহবিলের জন্য তারা ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে আবেদন করে। এমন ঐতিহাসিক ভবন সংস্কারকাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাম্বাসেডর ফান্ড ফর কালচারাল প্রিজারভেশন’ নামে একটা তহবিলও আছে। এ কাজের জন্য সেটাই পায় বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

এরপর প্রকল্পের কাজের জন্য তিনজন বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ করে অধিদপ্তর। আমি আর শ্রীলঙ্কার ড. টি এম জে নিলান কোরে সংরক্ষণ স্থপতি হিসেবে প্রকল্পে যুক্ত হই। ঐতিহাসিক অংশের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ থাকেন। ২০২০ সালে আমাদের কাজ শুরু হয়।

ইতিহাসের পথ ধরে

সংস্কারের আগের চেহারা
ছবি: স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর সৌজন্যে

সংরক্ষণের প্রথম কাজ হলো সঠিক ডকুমেন্টেশন। এ জন্য ইতিহাসের পথে হাঁটতে হলো। শাহনাওয়াজ ভাই জানালেন হাম্মামখানা কী, গোড়াপত্তনের ইতিহাস, কীভাবে ব্যবহার করতেন মোগলরা। আমরা জানতে পারলাম, লালবাগ কেল্লা তৈরির কাজ যে শাসক শুরু করেছিলেন, তিনি থাকতেন চাঁদনী বজরায়। বুড়িগঙ্গাপারের যে জায়গাটা বর্তমানে চাঁদনী ঘাট নামে পরিচিত, সেখানেই নোঙর করা থাকত এই নৌকা। দিনের বেলা এসে নির্মাণকাজ তদারক করতেন তিনি। এখানে অফিস করতেন। তাঁর গোসলের প্রয়োজন হতো, শৌচাগার ব্যবহারের দরকার পড়ত। সে কারণে প্রথমেই তিনি তৈরি করান গোসলখানা। মোগলরা যাকে বলত হাম্মামখানা। হাম্মামখানায় গরম পানি ও ঠান্ডা পানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পুরো কেল্লা নির্মাণ সম্পন্ন হলে হয়তো হাম্মামখানাটি পশ্চিম পাশের আবাসিক এলাকায় স্থানান্তরিত হতো।

হাম্মামখানার সামনের দ্বিতল ভবনটা দেওয়ান-ই-আম বা দরবার হল। আমজনতার সঙ্গে বৈঠক হতো বলেই এমন নাম।

ধাপে ধাপে সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়
ছবি: স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর সৌজন্যে

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকে লালবাগের কেল্লা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সেনানিবাস। থাকার জন্য দরবার হলে পরিবর্তন আনে তারা। মোগল ভবনের গায়ে ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির ছাপ পড়ে। ভবনের পেছন দিকে একটা বড় সিঁড়িও বানায়। দরবার হল থাকে খোলামেলা। অনেকটা প্যাভিলিয়নের মতো কাঠামো। ব্রিটিশরা আবাসন–সুবিধার জন্য দরজা-জানালা বানিয়ে সে কাঠামোয় পরিবর্তন আনে।

পাকিস্তান শাসনামলেও এখানে পরিবর্তন আসে। ১৯৬৮ বা ১৯৬৯ সালে পুরো ভবন একবার সংস্কার করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও অনেক কাজ হয়। আসে পরিবর্তন। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, এসব কাজে একটা ভুল হয়েছিল—সেটা হলো সিমেন্ট–সুরকির প্লাস্টার ব্যবহার। এতে স্থায়িত্ব হারায় চুন–সুরকির কাঠামো।

ফাটলে সমস্যা নেই

চলছে কাজ
ছবি: স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর সৌজন্যে

 ডকুমেন্টেশনের পরের কাজটি ছিল দোতলার ফাটলের কারণ চিহ্নিত করা, ফাটলটা কী পরিস্থিতিতে আছে, তা জানা। যে ফাটলের কারণে নিরাপত্তাঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৫–২০ বছর আগে দোতলায় দর্শনার্থীদের ওঠা বন্ধ করে দিয়েছিল।

আমরা নানা ধরনের পরীক্ষা করলাম। ইটের বোঝা দিয়ে স্থায়িত্ব পরীক্ষা করা হলো। দেখলাম, যে পরিমাণ ওজন দেওয়া হয়েছে, তাতে ১০০ জন মানুষ দোতলায় উঠলেও ছাদ ভেঙে পড়বে না। তার মানে হলো ফাটলটা মূল কাঠামোতে নয়। নানা সময় সিমেন্ট–সুরকির যে ঢালাই দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই দেখা দিয়েছে ফাটল। এভাবে ছয়–সাত মাস লাগল ডকুমেন্টেশন করতে। তার পরের পর্যায়ে সংরক্ষণের কাজ শুরু করলাম।

বেরিয়ে এল সিঁড়ি

সংস্কারের বিভিন্ন পর্যায়
ছবি: স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর সৌজন্যে

তখন ইট-সুরকির গায়ে লেপটে থাকা সিমেন্টের প্লাস্টার সরিয়ে ফেলা ছিল আমাদের প্রথম কাজ। প্লাস্টার সরানোর পরই বেরিয়ে আসে বিভিন্ন সময় ভবনে যুক্ত হওয়া নানা অংশ। নতুন ইট, ইটের গাঁথুনি, নতুন মসলার ব্যবহার—এসব দেখলে যে কেউ নতুন আর পুরোনোর পার্থক্যটা বলে দিতে পারবে। দরবার হলে ইট-সিমেন্টের দেয়াল পাওয়া গেল, যা দিয়ে উন্মুক্ত জায়গা বন্ধ করা হয়েছিল। এগুলো অপসারণ করে ফেলা হলো। আদি রূপ ফিরে পেল দরবার হল। নতুন দেয়াল অপসারণের পর পুরোনো সিঁড়িরও সন্ধান পাওয়া গেল। দুই পাশে দুটি সিঁড়ি। এত দিন যা আড়ালেই ছিল। প্লাস্টার খোলার সময় দেখি, পাকিস্তান আমলে নতুন সিঁড়ি বানানো হয়েছিল। আমরা নতুন সিঁড়ি ভেঙে দিয়ে পুরোনো সিঁড়িতে ফিরে গেলাম।

হাম্মামখানায় আলো পড়ল

ছাদের বাড়তি প্লাস্টার সরাতেই আলো পড়লো গোসলখানায়
ছবি: স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর সৌজন্যে

হাম্মামখানা মানে গোসলখানা। এখানে গোপনীয়তার ব্যাপার আছে। কিন্তু সেখানে বড় জানালা তৈরি করা হয়েছিল। সাধারণত এমন জানালা থাকার কথা না। আগেকার হাম্মামখানার চরিত্র অনুযায়ী, আলো-বাতাস আসার কথা ওপর থেকে। প্লাস্টার সরাতেই ওপরে মিলল গর্ত। নতুন তৈরি জানালা বন্ধ করা হলো। আলো-বাতাস একই থাকল, আদি রূপ ফিরে পেল হাম্মামখানা।

লালবাগের হাম্মামখানা
ছবি: স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ–এর সৌজন্যে

২০১২ সালে হাম্মামখানার একটি কক্ষের মেঝেতে কংক্রিটের ঢালাই করা হয়। বাইরে থেকে লাগানো হয় দরজা। এভাবে স্যুভেনির শপ হিসেবে কক্ষটাকে গড়ে তোলা হয়। কক্ষের কিছু অংশ ভাঙার পর দেখা গেল, এখানে চুল্লি ছিল। চুল্লিটা পুরোপুরি বের হয়ে এল। এখানে পানি গরম করা হতো। এই চুল্লিকক্ষের দেয়ালের প্লাস্টার আগের মতোই আছে। আমরা কক্ষটা সেভাবেই রেখেছি।

হাম্মামখানার সংস্কারকাজটি আমাদের জন্য মডেল হয়ে থাকল। পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক কোনো ভবন বা স্থাপনা সংরক্ষণের কাজ করতে গেলে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যাবে। হাম্মামখানা নিয়েও যাঁরা পরে কাজ করবেন, এই ডকুমেন্টেশন তাঁদের কাজকে সহজ করবে।

হাম্মামখানা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয় ২০২৩ সালে। সে বছরের ২২ মার্চ তা খুলে দেওয়া হয়। এখন আদি রূপ দেখতে পাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।

লেখাটি বর্ণিল বসত নভেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত