‘নট আ বোরিং কমপিটিশন’ এর ফাইনালে বাংলাদেশ, কিন্তু যাওয়া হবে তো?

বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রে চলছে এই শিক্ষার্থীদের কর্মযজ্ঞ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বানাতে হবে মস্ত এক যন্ত্র। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাটি খনন করে সুড়ঙ্গ তৈরি করাই হবে যন্ত্রের কাজ। সারা বিশ্বের উদ্ভাবনপ্রিয় তরুণদের এমনই এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। টেসলা মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবেই তিনি পরিচিত বেশি। তবে অনেকে হয়তো জানেন না, ‘দ্য বোরিং কোম্পানি’ নামেও ইলন মাস্কের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আয়োজিত হয় ‘নট আ বোরিং কমপিটিশন’। এখানে বোরিং শব্দের অর্থ কিন্তু একঘেয়ে নয়; খনন করা।

২০২১ সালে চালু হওয়া এ আয়োজনের তৃতীয় আসরে বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা দলের মধ্য থেকে সেরা ১০টি দলকে দেওয়া হয়েছে ফাইনালের টিকিট। সুখবর হলো দেশের মধ্যে তো বটেই, পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই প্রথম দল হিসেবে এই তালিকায় সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের দল ‘বোরড টানেলার্স’।

আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের বাসট্রপে বসবে আট দিনের ফাইনাল আসর। চ্যাম্পিয়ন শিরোপার পাশাপাশি নতুন উদ্ভাবন, ডিজাইন, নির্ভুল নেভিগেশন ইত্যাদি বিভাগেও দেওয়া হবে আলাদা পুরস্কার।

আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, একটি দল

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এক ছাতার নিচে এসে নিজেদের নাম দিয়েছেন ‘বোরড টানেলার্স’। কীভাবে এক হলেন তাঁরা? দলনেতা শায়েখ মোহাম্মদ শিথিল উত্তর দিলেন, ‘আমি, শাহরিয়ার ইকবাল ও ফাহিন উদ্দিন অনেক দিনের বন্ধু। আমাদের মধ্যে দুজন যেহেতু যন্ত্রপ্রকৌশলের শিক্ষার্থী, ইলন মাস্কের খবরাখবর আমরা স্বাভাবিকভাবেই রাখি। বলা যায় আমরা তাঁর বড় সমর্থক। তাই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হলেও তাঁকে আর তাঁর কাজ সামনাসামনি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি।’ দলের সদস্য এখন ১৮ জন। একেকজন একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের, একেক বিভাগের শিক্ষার্থী। বোঝাই যায় ‘বোরড টানেলার্স’–এ বেশ বৈচিত্র্য আছে।

আরও পড়ুন

প্রকল্পের আদ্যোপান্ত

যেকোনো টানেল করতেই সাধারণত টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) নামে একটি যন্ত্র লাগে। মোহাম্মদ শিথিল বলছিলেন, ‘সহজ কথায়, এই টিবিএম মেশিনকেই আরও আধুনিক করতে চান ইলন মাস্ক। এ জন্যই তিনি সারা বিশ্বের মাথাগুলোকে কাজে লাগাতে চান।’ ৩০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫০ সেন্টিমিটার প্রস্থের টানেল নির্মাণ করার পরীক্ষা (টাস্ক) দেওয়া হয় প্রতিযোগীদের।

সহদলনেতা শাহরিয়ার ইকবাল যোগ করলেন, ‘টানেল নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ট্রাফিক সমস্যার সমাধান। রাস্তা খুঁড়তে গিয়ে যেন চলাচলে সমস্যা না হয়, নিশ্চিত করা। আমরাও সেটি মাথায় রেখেই যন্ত্রটি তৈরি করেছি। গত বছরের মার্চে যখন প্রাথমিক রাউন্ডের জন্য প্রস্তুতি নিই, টিবিএম নির্মাণ শেখার তেমন কোনো উপকরণই ছিল না। একদম শুরু থেকেই শুরু করতে হয়েছে। ডিজাইন, মডেল, প্রোটোটাইপসহ প্রযুক্তিগত কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর তিনবার আমাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।’ এরপরই ফাইনালের টিকিট পেয়েছে দল।

স্বপ্ন কি থমকে যাবে

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা নিয়মিতই আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে পুরস্কার আনছেন। কিন্তু অন্য প্রতিযোগিতার সঙ্গে ‘নট আ বোরিং কমপিটিশন’-এর পার্থক্য হলো, এতে অংশ নিতে হলে শুধু বড় একটা যন্ত্র বানালেই চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রে এটাকে বয়ে নিয়েও যেতে হবে। দলের প্রযুক্তিবিষয়ক প্রধান ফাহিন উদ্দিন বুঝিয়ে বলেন, ‘আমরা নিজেরাই মডেল, ডিজাইন ও প্রোগ্রামিং করে আমাদের মেশিনের সব অংশ তৈরি করছি। বোরিং মেশিনটির ওজন প্রায় ১ হাজার ৫০০ কেজি। এটাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিতে হলেও বড় অঙ্কের টাকা দরকার। এখনো যেহেতু কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই, দলের সদস্যদের টাকা দিয়েই এটি নির্মাণ করা হচ্ছে৷ তবে ওয়ার্কশপের বেশ কিছু কাজে প্রায় ৪০ শতাংশেরও বেশি ছাড় দিয়ে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক)।’

যন্ত্রটিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিতে হলে জাহাজই ভরসা। জনসংযোগপ্রধান প্রীতম দত্ত বলছিলেন, ‘ছোট রোবট বা যন্ত্র হলে সেটা খুলেও নেওয়া যায়। আমাদের সে সুযোগও নেই।’ যন্ত্রটি নিয়ন্ত্রণের জন্যও প্রয়োজন বড় একটি দল। বড় দলের ভ্রমণ, থাকা-খাওয়ার জন্যও বড় অঙ্ক খরচ হবে। তাই আর্থিক চিন্তাটাই এখন এই তরুণদের প্রধান মাথাব্যথা।

যেহেতু দলটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে গড়া, অর্থের জোগানের জন্য শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। মোহাম্মদ শিথিল বললেন, ‘আমাদের প্রজেক্ট কিন্তু আমাদের দেশের জন্যও বেশ প্রাসঙ্গিক। শুধু তো টানেল নির্মাণ নয়; মাটির নিচ দিয়ে পানি, গ্যাস বা বিদ্যুতের লাইন টানতে, রাস্তা খনন করতেও এই মেশিন সাহায্য করবে। কর্ণফুলী নদীর টানেল তৈরি করতে চীনা কোম্পানির টিবিএম মেশিন ব্যবহার করতে হয়েছিল। সেটি পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলও সঙ্গে এসেছিল। অন্য অনেক নির্মাণের জন্যও ভরসা করতে হয় বিদেশি কোম্পানির ওপর। কিন্তু আমরা দেশেই যদি এটি তৈরি করে ফেলি, একদিকে যেমন নির্মাণ খরচ কমবে, অন্যদিকে দেশের টাকা দেশেই থাকবে।’

দলের উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনের পিএইচডি গবেষক সালমান প্রমন। তাঁর বক্তব্য, ভবিষ্যতে সম্ভাবনাময় অবস্থানে পৌঁছতে হলে এই তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া দরকার। পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কার্যকর নীতিমালা থাকা দরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবেই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’