৪০ পেরিয়েও খেলাধুলায় তাঁরা অদম্য
৪০-এর কোঠায়ই নাকি ক্যারিয়ারের ইতি টানেন অধিকাংশ পেশাদার খেলোয়াড়। কিন্তু অনেক ক্রীড়াবিদ আছেন, যাঁরা ‘বয়স কেবলই একটা সংখ্যা’—কথাটা মনে করিয়ে দেন বারবার। তেমনই তিনজন সম্পর্কে জানা যাক আজ।
নর্বার্ট শেমান্সকি আজও অনুপ্রেরণার নাম
নর্বার্ট শেমান্সকি। নর্ব নামেই পরিচিত বেশি। ১৯২৪ সালে মিশিগানে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকে অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের স্বপ্ন দেখতেন নর্ব। সেই লক্ষ্যেই পা রাখেন পেশাদার ভারোত্তোলনের জগতে। ১৯৩৯ সালে প্রথম নিজের করে নেন অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ইউনিয়নের ‘এএইউ হেভিওয়েট ডিভিশন’ শিরোপা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজের স্বপ্নটাকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীতে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে আবার লেগে পড়েন নিজেকে প্রস্তুত করার যুদ্ধে।
১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভারোত্তোলনের ‘ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে’ অর্জন করেন দ্বিতীয় স্থান। এরপর একে একে ১৯৫১-তে মিলান, ১৯৫৩-তে স্টকহোম আর ১৯৫৪-তে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে জিতে নেন প্রথম স্থান। ১৯৫২ সালে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে নর্ব তাঁর স্বপ্ন সত্যি করে জয় করেন স্বর্ণপদক। এ ছাড়া একাধিকবার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ এবং অলিম্পিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন তিনি। প্রায় সব পেশাদার ভারোত্তোলকের ক্যারিয়ারের গ্রাফ যেখানে ৩০ বছরের আশপাশে এসে নিম্নগামী হয়, নর্বার্টের ফর্ম তখন ছিল তুঙ্গে। ১৯৬৪ সালে টোকিও অলিম্পিকে চল্লিশোর্ধ্ব নর্বার্ট জেতেন তাঁর চতুর্থ পদক। অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি পদকের মালিক হিসেবে গড়েন নতুন রেকর্ড।
পরিসংখ্যান যেখানে বলে, অলিম্পিকে ভারোত্তোলকদের ৮০ শতাংশ ক্রীড়াবিদই ২৪ থেকে ২৬ বছর বয়সী, নর্ব সেখানে ৪০ বছর বয়সেও অলিম্পিকে জিতেছেন ব্রোঞ্জপদক। পেশাদার ভারোত্তোলক তিনি, বয়সের ভার তাঁর কাছে পাত্তা পাবে কেন!
এখানেই শেষ নয়, নর্বার্টের প্রতিযোগিতামূলক ভারোত্তোলন ক্যারিয়ার শেষ হয় ১৯৭২ সালে, যখন তাঁর বয়স ৪৮! সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক ওয়েটলিফটার হিসেবে পদক জয় ছাড়াও তাঁর ক্যারিয়ারে আছে আরও বহু রেকর্ড। এসবের সুবাদেই ‘ন্যাশনাল ওয়েটলিফটিং হল অব ফেইম’ আর ‘ন্যাশনাল পলিশ-আমেরিকান স্পোর্টস হল অব ফেইমের’ দেয়ালে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। অবসর গ্রহণের পর নিজের শহরে পুরকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৯২ বছর বয়সে মারা যান এই চ্যাম্পিয়ন ক্রীড়াবিদ।
বুফন এখনো দাঁড়িয়ে থাকেন দেয়াল হয়ে
১৯৭৮ সালে ইতালির কাররারা শহরে জিয়ানলুইজি বুফনের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলে তুমুল আগ্রহ। ১৯৯১ সালে মিডফিল্ডার হিসেবে ইতালিয়ান ক্লাব পার্মা ক্যালশিওর ইয়্যুথ টিমে যোগ দেন। হঠাৎ দলের দুজন গোলরক্ষক একসঙ্গে ইনজুরিতে পড়লে কোচের উৎসাহে হাতে উঠিয়ে নেন কিপিং গ্লাভস। সেই যে শুরু, এরপর ১৯৯৫ সালে যোগ দেন পার্মা ক্যালশিওর প্রধান দলে, আলো ছড়াতে থাকেন ‘সিরি আ’, ‘কোপা ইতালিয়া’, ‘ইউএফা’ কাপের মতো মঞ্চে। শিগগিরই সমর্থকদের মনে জায়গা করে নেন। বুফনের কড়া পাহারায় তখন পার্মার জালে বল পাঠানোর চেষ্টা যেন মাঝনদীতে ঠাঁই খোঁজা। মিলান, জুভেন্টাসের মতো বড় বড় দলের বাঘা বাঘা ফরওয়ার্ডরাও স্কোরবোর্ডে কিছু যোগ না করেই বাধ্য হয়েছেন মাঠ ছাড়তে। যে পার্মা কয়েক সিজন আগে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাই করার জন্য ধুঁকছিল, বুফনের জাদুতে তারা জিতে যায় কোপা ইতালিয়া ও ইউএফা কাপ। বুফনের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে ইতালীয় জায়ান্ট জুভেন্টাস রেকর্ড পরিমাণ টাকা খরচা করে তাঁকে দলে ভেড়ায়। জুভেন্টাসের হয়ে বুফন জেতেন ‘সিরি আ’ টাইটেল। এরপর একে একে জিততে থাকেন বহু অ্যাওয়ার্ড, ভাঙতে থাকেন নানা রেকর্ড। ইতিহাসের প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে তিনি ‘সিরি আ’র প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডও অর্জন করেন। জাতীয় দলের হয়ে ২০০৬ সালে হাতে তুলে নেন ফুটবল বিশ্বকাপ। সে বছর বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষকও নির্বাচিত হন জিয়ানলুইজি বুফন।
পার্মা, জুভেন্টাস, পিএসজি ও ইতালির জাতীয় দলের জন্য বুফনের অনন্য অবদান তাঁকে নিয়ে গেছে সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকদের তালিকায়। সমর্থকদের মুখে জিজি বা সুপারম্যান নামেই বেশি পরিচিত। ৪৪ বছর বয়সেও ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড হাতে বেঁধে সামলাচ্ছেন জীবনের প্রথম ক্লাব পার্মার গোলবার। বয়সটা ৪৫ ছুঁই ছুঁই, তবু এখনো বুফনের ‘দেয়াল’ পেরিয়ে গোলপোস্টে বল ঢোকাতে হিমশিম খায় প্রতিপক্ষ।
লাল বলের খেলায় জিমি আছেন ঠিকই
লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মেঘে ঢাকা দুপুর, ব্যাট হাতে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি রিকি পন্টিং। অ্যাশেজ সিরিজের এই ম্যাচটা জিততে পন্টিংয়ের উইকেটটা যে খুবই জরুরি ইংল্যান্ডের জন্য। হাতে বল তুলে নিলেন জিমি। স্বাভাবিক ছন্দে দৌড়ে এসে অফ স্টাম্পের অনেকখানি বাইরে একটা বল ছুড়লেন। আউট! জিমির অসাধারণ কয়েকটা স্পেলে ভর করে ইংল্যান্ড জিতে যায় সেই ম্যাচ, সঙ্গে পুরো সিরিজ।
জিমি বা জেমস অ্যান্ডারসন বল হাতে এমন কাজ তাঁর লম্বা ক্যারিয়ারে বহুবার করেছেন। ফাস্ট বোলার হিসেবে সফল হতে গতির সঙ্গে চাই পারফেক্ট সুইং। শোনা যায়, লাল ক্রিকেট বলটা নাকি জিমির কথামতোই চলে। যেদিকে ইচ্ছা বল সুইং করিয়ে ২২ গজের পিচে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের রীতিমতো নাচিয়ে ছাড়েন।
জেমস অ্যান্ডারসনের জন্ম ১৯৮২ সালে ল্যাঙ্কাশায়েরের বার্নলি শহরে। কৈশোর পেরিয়ে যোগ দেন ল্যাঙ্কাশায়ের কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবে। কাউন্টি ক্রিকেট খেলেন মাত্র তিন ম্যাচ। এর মধ্যেই ২০০২ সালে ইংল্যান্ড দলে ডাক পেয়ে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে ১০ ওভার বল করে খরচ করেন মাত্র ১২ রান। সিরিজজুড়ে অ্যান্ডারসনের ধারালো বোলিং তাঁকে জায়গা করে দেয় পরের বছর বিশ্বকাপের দলে। তবে সাদা বলের চেয়ে লাল বলের ফরম্যাটটাই জিমির বেশি পছন্দ। টেস্ট ক্রিকেটে শিকার করেছেন সাড়ে ছয় শর বেশি উইকেট। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতেও উইকেট কম নয়। সর্বকালের সেরা সুইং বোলার হিসেবে গ্লেন ম্যাকগ্রা, ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খানদের পাশে জায়গা করে নিয়েছেন। সাদা বলের ফরম্যাটগুলোয় ইংল্যান্ডের লাল-নীল জার্সিতে অ্যান্ডারসনকে এখন দেখা না গেলেও দিব্যি সাদা পোশাকে মাঠ মাতিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বয়স ৪০ পেরিয়ে গেলেও ইংল্যান্ড টেস্ট দলের নিয়মিত মুখ তিনি। বয়সের সঙ্গে যেন জিমির বল হয়েছে আরও ধারালো। যে বয়সে বেশির ভাগ পেস বোলার অবসর নিয়ে টিভিতেই খেলাটা উপভোগ করেন, সে বয়সে জিমি থাকেন এখনো ‘টিভির ভেতর’।