গণিতের ছাত্রী শারমিন যেভাবে ভুট্টাচাষি হয়ে উঠলেন
নবসে থাকার মানুষ শারমিন সুলতানা না। তার গত দুই-চার বছরের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি দিলেই বিষয়টা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকে টিউশনি করতেন শারমিন। এরপর কিছুদিন ধানের আবাদ করেছেন, অনলাইনে পোশাক বিক্রির ব্যবসা করেছেন। গত নভেম্বরে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের অধীন পরিবারকল্যাণ সহকারী পদে যোগ দিয়েছেন। আর চলতি মৌসুমে শুরু করেছেন ভুট্টার চাষ।
শারমিনের কিছু উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেছে। কোনোটা হয়তো তেমন লাভজনক হয়নি। কিন্তু লাভ-লোকসান ছাপিয়ে নানা অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে। সেসবের গল্প শুনতেই ৭ এপ্রিল তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হই।
শেরপুর সদর উপজেলার নলবাইদ গ্রামের দরিদ্র পল্লি চিকিৎসক রফিকুল ইসলামের মেয়ে শারমিন সুলতানা। শেরপুর সরকারি কলেজের গণিত বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। ছেলেবেলা থেকেই দারিদ্র্য দেখেছেন। তাই নানাভাবে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ২০২০ সালে করোনা শুরুর আগে নলবাইদ গ্রামে আড়াই বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু তেমন লাভ হয়নি। করোনার সময় অনলাইনে পোশাক বিক্রি শুরু করেন। তাতে কিছুটা লাভ উঠে আসে। ব্যবসা আর টিউশনি থেকে যা আয়, তা-ই নতুন করে কাজে লাগিয়েছেন তিনি।
পরিবারকল্যাণ সহকারী পদে চাকরির সুবাদে শারমিনকে প্রায় প্রতিদিন গ্রামের নানা প্রান্তে যেতে হয়। তখন থেকেই তাঁর নজরে আসে, পতিত পড়ে আছে অনেক কৃষিজমি। সদর উপজেলার চরমোচারিয়া ইউনিয়নের নলবাইদ গ্রামের তিন কৃষকের কাছ থেকে সাত বিঘা জমি আবাদের জন্য চুক্তির ভিত্তিতে নেন তিনি। এরপর স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জাহানারা বেগমের পরামর্শে চলতি রবি মৌসুমে শুরু করেন ভুট্টার আবাদ।
খরচ কম, লাভ বেশি
নলবাইদ গ্রাম ঘুরে চোখে পড়ল, অধিকাংশ জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। এসবের মধ্যেই শারমিনের ভুট্টাখেত। সবুজ পাতায় ভরা খেতগুলোর পরিচর্যা করছিলেন শারমিন। বেলে ও বেলে দো–আঁশ মাটির পতিত জমিতে আবাদ করা ভুট্টার খেত এখন সবার নজর কাড়ছে।
শারমিন বলেন, ‘পড়ে থাকা জমি দেখে ভুট্টা আবাদে উদ্বুদ্ধ হই। আমাকে উৎসাহিত করতে সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ প্রণোদনা হিসেবে আমার দুই বিঘা জমির জন্য ৪ কেজি ভুট্টাবীজ ও ৬০ কেজি বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার দিয়েছে। পাশাপাশি সাত বিঘা জমিতে ভুট্টা আবাদের জন্য বীজ, সার, শ্রমিক খরচসহ মোট এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি।’
শারমিন জানান, ধানের চেয়ে ভুট্টার আবাদে খরচ কম, লাভ বেশি। এ কারণেই ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়েছেন তিনি। আবহাওয়া যদি অনুকূলে থাকে, এবার বাম্পার ফলনের আশা করছেন তিনি। এর মধ্যে লাভ-খরচের অঙ্কটাও কষে ফেলেছেন গণিতের এই ছাত্রী, ‘চলতি মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে ৩০ মণ ভুট্টা উৎপন্ন হওয়ার কথা। সে হিসাবে ৭ বিঘা জমিতে আমি ২১০ মণ ভুট্টা পাব। প্রতি মণ ভুট্টার বাজারমূল্য ১ হাজার ২০০ টাকা। সে হিসাবে উৎপন্ন ভুট্টা বিক্রি করে আড়াই লাখ টাকা পাওয়ার কথা।’ ভুট্টা বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন—এই কৃষি উদ্যোক্তার এমনটাই প্রত্যাশা।
শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘দেশে ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পুষ্টিগুণের কারণে তো বটেই, পাশাপাশি পোলট্রি, ডেইরি ও ফিশফিড হিসেবেও এর চাহিদা প্রচুর। কৃষি বিভাগের প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় শারমিন সুলতানাকে বীজ, সার ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাঁর বেশ উৎসাহ আছে। আশা করি, সফল নারী কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।’