৪০ বছর ধরে বিপন্ন পাখি ও প্রাণী নিয়ে কাজ করছেন কুষ্টিয়ার ‘ফক্সম্যান’
৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বিপন্ন পাখি ও প্রাণী নিয়ে কাজ করছেন কুষ্টিয়ার শাহাবউদ্দিন মিলন। তাদের নিরাপদে রাখতে মিলনের ভাবনার শেষ নেই। তাঁর গল্প শোনাচ্ছেন তৌহিদী হাসান
কুষ্টিয়া শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে গড়াই নদ। পদ্মার শাখা নদটি শহরের মানুষের দম ফেলার জায়গা। নদে দিনভর মাছ ধরেন জেলেরা। এ মাসের শুরুতে সেই গড়াই নদেই একটি কুমির এসে হাজির। এখন কী হবে? শাহাবউদ্দিন মিলনকে ফোন করলেন স্থানীয় লোকজন। কুষ্টিয়ায় প্রাণী ও পাখি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন বলে সবাই চেনেন। কিছুদিন আগে রাসেলস ভাইপার নিয়ে যখন আতঙ্ক, তখনো সাপ উদ্ধার করে মানুষের পাশে ছিলেন তিনি। ফোনকল পেয়ে মিলন ভাবলেন, ভুলও দেখে থাকতে পারে মানুষ। তবে নিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে দেখলেন, সত্যিই প্রাণীটা কুমির। বন বিভাগ মনে করছে, বন্যার সময় এই নদী-ওই নদী ঘুরে গড়াইয়ে কুমিরটার আগমন।
মানুষকে সচেতন করা শুরু করলেন মিলন। কেউ যেন কুমিরটাকে বিরক্ত না করে, সে জন্য সচেতনতামূলক সাইনবোর্ডও টাঙালেন। কুমিরের ক্ষুধা মেটানো গেলে জেলেদের আক্রমণ করবে না ভেবে তার খাবারের জন্য হাঁস, মুরগি ও ছাগল নিলেন। এসব পশুপাখির মালিকের সঙ্গে চুক্তি হলো—কুমির খেয়ে ফেললে মূল্য পরিশোধ করা হবে। তবে কুমির আর সেগুলো খেল না। এরপরও হাল ছাড়লেন না মিলন, দিনের পর দিন বসে থাকলেন তিনি।
এখনো আচমকা কুমিরটির দেখা মেলে। তবে উৎসুক মানুষের ভিড় কমেছে; কিন্তু মিলন আর তাঁদের বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশন (বিবিসিএফ) কুষ্টিয়া শাখা আছে সচেতনতার বার্তা নিয়ে।
শুধু কুমিরের জন্যই যে শাহাবউদ্দিন মিলনের মন ছুটে যায়, এমন নয়। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে পাখি ও প্রাণীদের সেবা–যত্ন করেন তিনি, তাদের পাশে থাকেন।
শিয়ালের সঙ্গে সখ্য
দুই যুগের বেশি আগের কথা। একদিন মিলন দেখেন, একটি শিয়ালের বাচ্চা আহত হয়ে পড়ে আছে। তার লেজে আঘাতের চিহ্ন। ক্ষতস্থানে ঘা হয়ে গেছে। নড়তে পারছে না। বাচ্চাটাকে তুলে বাসায় আনেন তিনি। চিকিৎসা করান, দুধ খাওয়ান। সুস্থ হয়ে উঠলে বাচ্চাটাকে ছেড়ে দেন।
এর পর থেকে রাত হলেই শিয়ালের বাচ্চাটা বাড়ির সামনে আসতে থাকে। ধীরে ধীরে বাচ্চাটার সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। বাচ্চাটা বড় হলে তার সঙ্গে আরও কয়েকটি শিয়াল আসা শুরু করে। প্রতিরাতেই বাইরে থেকে বাড়ি ফেরার সময় পাউরুটি ও কেক নিয়ে আসতেন মিলন। শিয়ালগুলোকে সেসব দিয়ে ঘরে ঢুকতেন। তিনি এসব শিয়ালের নামও দিয়েছিলেন—সেরো, কাঞ্চি, আহ্লাদী, রাহাজানি, রঘু, জেরিসা, চিন্টু, ভলভো, ছুটকি, রঙিলা।
শিয়ালের সঙ্গে মিলনের সখ্য এখনো বহাল রয়েছে। এলাকার মানুষ এ জন্য তাকে ‘ফক্সম্যান’ নামেও ডাকেন। একসময় ৪০টি শিয়াল ছিল, বর্তমানে সেরো, আহ্লাদী, ছুটকিসহ ১৫টির মতো মিলনের সঙ্গে দেখা করতে আসে। শিয়ালগুলো কাউকে তাড়া করে না, কামড়ায় না; বরং মানুষ দেখলে ভয় পায়। এলাকার কুকুরগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে থাকে তারা। মিলনের মতে, ‘প্রতিটি প্রাণীর চোখের একটি ভাষা আছে। সেই ভাষা যদি ঠিকমতো পড়া যায়, তবে সব হিংস্র প্রাণীই বশ মানে। কারণ, কোনো প্রাণীই হিংস্র নয়। সাপ, বেজি, ইঁদুরসহ সব প্রাণীর সঙ্গে সখ্য করেছি।’
পাখি-প্রাণীর মায়ায়
২০০৭ সালে পাখির আশ্রয় নিরাপদ করতে কাজ শুরু করেন শাহাবউদ্দিন মিলন। বিভিন্ন আবাসিক স্থাপনার পাশে পাখি যাতে নিরাপদে বসবাস ও বাচ্চা ফুটাতে পারে, সে জন্য বাসা তৈরি করে দেন তিনি। ২০১২ সাল থেকে গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি এবং পরে বাঁশের তৈরি বাসা বেঁধে দিয়েছেন। এখনো কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় গাছে গাছে পাখির বাসা বেঁধে দেন মিলন। পাশাপাশি এ পর্যন্ত শতাধিক পাখি উদ্ধার করেছেন তিনি। তার মধ্যে অন্যতম ভুবনচিল, প্যাঁচা ও মদনটাক। বাচ্চাসহ মা প্যাঁচা উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসেন মিলন। সুস্থ করে আবার ছেড়ে দেন।
কয়েক বছর ধরে কুষ্টিয়ায় রাসেলস ভাইপারের বিচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। পদ্মা-গড়াই পাড়ে যখনই সাপের খোঁজ পান, ছুটে যান মিলন। উদ্ধার করে বন বিভাগের মাধ্যমে সুবিধাজনক স্থানে ছেড়ে দেন। এভাবে গত চার বছরে ১৪টি রাসেলস ভাইপার উদ্ধার করেছেন তিনি।
কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পাখি বা প্রাণী ধরা পড়ার খবর পেলেই মিলন ছুটে যান। এভাবে ২০টির অধিক মেছো বিড়াল উদ্ধার করে অন্য জায়গায় ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। অনেক সময় ফোন আসে—মাঠের মধ্যে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করা হচ্ছে। তখনো সেখানে ছুটে যান। শিকারিদের সঙ্গে কথা বলেন। শিকার না করার অনুরোধ করেন। কর্তৃপক্ষের সহায়তায় জালসহ শিকার করার জিনিসপত্র জব্দ করেন। মিলনের তৎপরতায় শিকার বন্ধও হয়।
প্রাণীদের জন্য হাসপাতাল
শাহাবউদ্দিন মিলনের বয়স এখন ৫৫ বছর। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই পাখি ও প্রাণীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাড়িতে কবুতর পোষা শুরু করেন তিনি। কবুতরের সঙ্গে অন্যান্য পাখিরও যাওয়া-আসা শুরু হয়। এখন তো শিস দিলেই হাতের কাছে ছুটে আসে কাঠবিড়ালি। তাঁর দেওয়া খাবার খায়। এসব ভিডিও ফেসবুকে নিজের ওয়ালে পোস্ট করেন মিলন।
কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ার বাসিন্দা মিলন। স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে সংসার। পেশায় মৌসুমি ব্যবসায়ী। তবে ধ্যানজ্ঞান প্রাণী ও পাখি নিয়ে। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ নামে কুষ্টিয়ায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি তিনি। প্রাণীর সেবা দিতে এলাকায় একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার স্বপ্ন আছে। মিলন বলেন, ‘অসুস্থ পশু-পাখিরও কষ্ট হয়, বলতে পারে না। সেই কষ্ট আমি বুঝতে পারি। ছোট পরিসরে একটি হাসপাতাল হলে তাদের সেবা দিতে পারব।’