‘আমার কিছু হবে না’ বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাবা
আমার বাবা মীর আবদুল কাইয়ূম ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। রাজশাহী শহর থেকে বাবাসহ মোট ১৪ জনকে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। স্বাধীনতার পর ৩০ ডিসেম্বর পদ্মা নদীর পাড়ে, শ্রীরামপুরে সরকারি বাংলোর সামনে একটি গণকবর চিহ্নিত করেন স্থানীয় লোকজন। সেখান থেকে বাবাসহ সবার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এক রশিতে ১৪ জনের মৃহদেহ বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাঁদের গায়ে কোনো বুলেটের চিহ্ন ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বড় ভাইয়ের বয়স ছিল সাড়ে ছয় বছর। আমার সাড়ে পাঁচ, ছোট বোনের সাড়ে তিন। বাবাকে যখন ধরে নেওয়া হয়, মা তখন অন্তঃসত্ত্বা। ১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি আমার ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়।
আমার বাবা সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তিনি ছাত্ররাজনীতি নিয়ে গবেষণা করতেন। তখন এখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে জনমানুষের মনোভাব কী, সেটাই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। যখন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, তখন তিনি এ রকম একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। নিঃসন্দেহে কাজটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল।
আমরা চার ভাইবোন এত ছোট ছিলাম যে ছোটবেলার স্মৃতি খুব বেশি নেই। রাজশাহীতে যখন প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমাদের বাসা ছিল মালোপাড়া, কাছেই টেলিগ্রাফ অফিস। সে সময় প্রথম এখানে গুলি চলে।
তিনতলায় ছিল আমাদের বাসা, সঙ্গে একটা খোলা ছাদ। ছাদে দাঁড়িয়ে বাবা দেখেছিলেন গোলাগুলি হচ্ছে। টেলিগ্রাফ অফিসের আশপাশে থাকা লোকজন সেখান থেকে পালিয়ে বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ছিল। বাবা ছাদ থেকে নেমে তাঁদের পালাতে সাহায্য করছিলেন। সে জন্য আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। খুঁজে দেখেছিল, এখানে মুক্তিযোদ্ধারা আছে কি না।
এ ঘটনার কিছুদিন পর কিছুদিনের জন্য রাজশাহীর বাঘায় চলে যান বাবা। সেখানেই ছিলেন কিছুদিন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব শিক্ষককে আবার কাজে যোগ দেওয়ার কথা বলা হলে বাবা ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন।
ফিরে এসে দেখেন, আমাদের বাসাটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাবার গবেষণাপত্র, বই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তখন আমার মা-বাবা রাজশাহীতে আমার নানির বাড়ি চলে যান। সেই বাসাতেই ২৫ নভেম্বর রাতে দরজায় টোকা পড়ে। ওপাশে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের তৎকালীন স্টেনোগ্রাফার তৈয়ব আলী। তিনি বলেন, ‘স্যার, আপনাকে একজন ক্যাপ্টেন ডাকছে। আপনি কি আসবেন?’
বাবার শরীরটা সেদিন ভালো ছিল না। মা নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু বাবা শোনেননি। ‘আমার কিছু হবে না,’ বলেই একটা শার্ট গায়ে চাপিয়ে পরিচয়পত্রটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মা পেছন পেছন গিয়ে দেখেন, একটা সাদা জিপ বাবাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সেই শেষ দেখা।
বাবা খুব স্পষ্টভাষী ছিলেন। ‘দেশ একদিন স্বাধীন হবেই, কিন্তু দেখে যেতে পারব তো?’ এ কথা প্রকাশ্যেই বলতেন। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে গবেষণা করতেন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছিল। শুনেছি, আমাদের বসার ঘরে ছাত্রনেতাদের নিয়ে মিটিং হতো। ফলে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ ও ওষুধ সরবরাহ করতেন।
বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনায় ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আবদুল বারী। তার অধীন মনোবিজ্ঞান বিভাগেরই দুজন শিক্ষক পাকিস্তানিদের সাহায্য করত—অধ্যাপক মতিউর রহমান ও ওয়াসিম বাঘী। স্বাধীনতার পর তারা দেশ থেকে পালিয়ে যায়। তাদের কোনো প্রকার শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি।
আমার কাছে মনে হয়, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধের পর যাদের জন্ম, আমরা যদি তাদের সত্যিকারের ইতিহাসটা না জানাতে পারি, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নিজের জীবন দিয়ে গেছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে না। শ্রদ্ধা প্রদর্শন তখনই হবে, যখন আমরা তাঁদের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে পারব। শুধু বিচারই নয়; হত্যাকারীকে হত্যাকারী বলতে শেখা, সামাজিক ঘৃণা তৈরি হওয়া—এগুলোও জরুরি।
আমরা যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করেছি, প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেছি, হত্যাকরীদের পুরস্কৃত করেছি, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। একটা জাতি কোনো দিন এ অপরাধ থেকে দায়মুক্ত হবে না।
শিক্ষার্থীরা, তোমরা আমাদের অনেক পরের প্রজন্ম। আমি আশাবাদী যে তোমরা মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাসটা জানবে। তোমরা জানবে, কত মূল্য দিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে।