২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যেভাবে তিনবারের চেষ্টায় গুগলে চাকরি পেলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নশিন

মীর নশিন জাহান
ছবি: সংগৃহীত

মীর নশিন জাহান কথা কম বলেন। বন্ধুদের আড্ডায়ও থাকেন চুপচাপ। তবে বইয়ের সঙ্গে আড্ডায় তাঁর ক্লান্তি নেই। বেশির ভাগ সময় কাটে ব্যক্তিগত কম্পিউটারে কোডিং করে। পরিবারও কখনো প্রোগ্রামিংয়ের ব্যাপারে বাধা দেয়নি। ব্যাংক কর্মকর্তা বাবা নশিনকে সমর্থন করেছেন সব সময়, মা–ও ছিলেন ছায়ার মতো। সাভার বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক করে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজিতে (আইআইটি) পড়ার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন নশিন। আর দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নাম লেখান।

তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে ঠিক করলেন ‘গুগল কোডিং কমপিটিশন ফর উইমেন’-এ অংশ নেবেন। এ জন্য একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে নিজেকে আলাদাভাবে প্রস্তুত করতে থাকেন। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সারা বিশ্বের নারীদের মধ্যে ৬৩তম স্থান লাভ করেন নশিন, ‘এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর চাকরির আবেদন পাঠানোর জন্য আমন্ত্রণ জানায় গুগল। মাত্র তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হওয়ায় ভয়ে তখন সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করিনি।’

২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির ৪৪তম ব্যাচের সাবেরা মাহমুদ ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের রিচিতা খন্দকারের সঙ্গে দল গঠন করেন নশিন। ২০১৮ সালে জাতীয় গার্লস প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা এবং ২০১৯ সালে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় গার্লস প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় তাদের দল।

আগোডায় কর্মরত থাকা অবস্থায় গুগলে চাকরির আমন্ত্রণ পান মীর নশিন
ছবি: সংগৃহীত

একই বছর আন্তর্জাতিক কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার (আইসিপিসি) ঢাকা অঞ্চলের কনটেস্টে অংশ নেন নশিন। সেখান থেকে একই প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেন। ২০২০ সালে স্নাতক (সম্মান) শেষ করার পর এ প্রতিযোগিতায় দেশ ও দেশের বাইরের অনেক প্রতিযোগীর মধ্যে সম্মানজনক স্থান লাভ করেন তিনি।

যেভাবে গুগলে চাকরি

এরপর বিশ্বের বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির আবেদন করতে থাকেন নশিন। তিনি বলেন, ‘স্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষার পরেই দেশ এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন টেক কোম্পানিতে সাক্ষাৎকার দেওয়া শুরু করি। অ্যামাজন, গুগল, আগোডাতে সাক্ষাৎকার দিই। আগোডা থেকে চাকরির প্রস্তাবও আসে।’ গত বছরের শুরুতে থাইল্যান্ডে আগোডার কার্যালয়ে কাজ শুরু করেন নশিন। সেখানে কর্মরত থাকা অবস্থায় গুগলে চাকরির আমন্ত্রণ পান।

নশিন জানান, গুগলে একবার সাক্ষাৎকার দেওয়ার সুযোগ হলে পরে তারাই প্রতিবছর চাকরির আবেদন করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আগোডাতে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকারের আমন্ত্রণ আসে। তবে এবারও ব্যর্থ হন। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে তৃতীয়বার সাক্ষাৎকারের সুযোগ এলে সফল হন।

চার ধাপে সাক্ষাৎকারের পর গুগলে যোগদানের চূড়ান্ত প্রস্তাব পেয়েছেন নশিন। জানালেন, ‘শুরুতে প্রাথমিক যাচাই–বাছাই করা হয়। অনলাইনে হওয়া এ সাক্ষাৎকারকে বলে ফোন স্ক্রিনিং। এ সময় প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আমাকে কোডিংয়ের সমস্যা সমাধান করতে হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে তিনবার ৪৫ মিনিট করে কোডিংয়ের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যাচাই করা হয়। এ ধাপকে বলা হয় ভার্চ্যুয়াল অনসাইট ইন্টারভিউ। এ সময় প্রথম ধাপের মতো কোডিংয়ের সমস্যা সমাধান করতে বলা হয়।’

এ দুটি ধাপ সফলভাবে শেষ করতে পারলে তৃতীয় ধাপে গুগলের সঙ্গে চাকরিপ্রত্যাশীর আচরণের মিল খুঁজে দেখা হয় বলে জানান নশিন। এটাকে বলে ‘গুগলিনেস’। এ সময় আচরণগত নানা প্রশ্ন করা হয়। যে দলের জন্য গুগল লোক খুঁজছে, সেই দলের শীর্ষস্থানীয়রাই চতুর্থ ধাপের সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকেন। এই পর্ব ‘টিম ম্যাচ ইন্টারভিউ’ হিসেবে পরিচিত। এভাবে সব ধাপ সম্পন্ন করার পরেই পেয়েছেন যোগদানের সুযোগ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নতুন বছরের শুরুতে তাইওয়ানের নিউ তাইপে শহরের গুগল কার্যালয়ে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেবেন নশিন জাহান।

টেক জায়ান্টগুলোতে কাজের আগ্রহ থাকলে কোডিংয়ের পেছনে আন্তরিকভাবে সময় দেওয়ার পরামর্শ দেন নশিন। তিনি বলেন, ‘লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া যাবে না। বিরতি নেওয়া যাবে কিন্তু হাল ছাড়া যাবে না। আর নিজের দক্ষতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কোডিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ভালো।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রোগ্রামিংয়ের উপযুক্ত পরিবেশ আছে বলেই তিনি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন নশিন জাহান, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষকেরা প্রোগ্রামিংয়ের ব্যাপারে সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা সব সময় পাশে ছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।’

নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে কাজ করে দেশের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে চান এই নারী, ‘সবার পক্ষেই যেকোনো কিছু করা সম্ভব। শুধু দরকার লেগে থাকার মানসিকতা। নিজেকে তৈরি রাখা খুব জরুরি। তাহলে খুব বেশি দৌড়ঝাঁপের প্রয়োজন হয় না।’