শীতের সকালে আপনারও কি ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না?
সুয্যিমামা সবে আড়মোড়া ভেঙেছে। আলো ছড়িয়ে বলছে, ‘ইশ্! আমি উঠলাম ভাগ্যিস, তাই রাত্তির হলো ভোর।’ আর ঠিক তখনই মুঠোফোনের অ্যালার্মটা বেজে উঠেছে। কিন্তু মায়ের বোনা নকশিকাঁথার উষ্ণতা থেকে হাত বের করে অ্যালার্মটা বন্ধ করা যে কঠিন। আরও কঠিন শীতের ভোরে ঘুমের জগৎ থেকে নিদারুণ কর্মময় জগতে ফেরা। ফিরব বললেই ফেরা যায় নাকি!
শরীর, মন বিদ্রোহ করে। দোষ কি শুধু শরীর-মনের? প্রকৃতিও যে তখন আড়মোড়া ভাঙেনি। বারান্দার টবে ফোটা ফুলগুলো শিশিরে ভিজে জবুথবু, সামনের ডাবগাছের লম্বা পাতাগুলোও যে কুয়াশা মেখে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। পায়ের কাছে ঘুমিয়ে আছে আদুরে বিড়ালছানা। মন বলে ওঠে, আহা যদি ফুল, পাতা নিদেন বিড়ালছানাটাও হতাম।
কিন্তু হতে তো হবে সকালবেলার পাখি। সবার আগে কুসুমবাগে উঠতে হবে জাগি। তবে চলুক সে প্রস্তুতি। দিনপঞ্জিকার পাতা বলছে, এখন হেমন্তের মাঝ বয়স। পৌষ ডাকাডাকি করছে। যান্ত্রিক নগর ঢাকায় অবশ্য শীতের আমেজ টের পাওয়া যায় সকাল-সাঁঝে। ঢাকার বাইরে বিশেষ করে উত্তরের দিকে কিন্তু সেই চিরচেনা কুয়াশাভেজা গাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে। সবুজ ঘাসগুলো শিশিরে ভিজেছে। আলমারি আর দেরাজ থেকে বেরিয়ে পড়েছে উলের টুপি, সোয়েটার, শাল। ভোরের দিকে সেগুলো গায়ে চাপাতেই হচ্ছে। হাতে এসেছে ধোঁয়া ওঠা গরম চা। সকালে সুয্যিমামার আলস্য ভাঙতেই টানা বারান্দার রেলিং বা খোলা ছাদে ভারী লেপ, কম্বলগুলো গা এলিয়ে দিয়েছে।
দেহঘড়ির অ্যালার্ম লাগে না
শীত কম হোক বা বেশি, ভোর আর সকালজুড়ে আলসেমির পারদ কিন্তু একই। রবিঠাকুরের ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন, আমলকীর এই ডালে ডালে/ পাতাগুলি শিরশিরিয়ে, ঝরিয়ে দিল তালে তালে’ গান যতই গুনগুন করি না কেন, ঘড়ির কাঁটার তালে তালে হাত–পা যেন চলে না। তবে জীবনের তাল মেলাতে গেলে তো বসে থাকলে চলবে না। তাই নকশিকাঁথাটা সরাতেই হবে। বারান্দায় বেরিয়ে উত্তরে হাওয়ায় একটু কেঁপে না উঠলে শরীরটা যে আড়মোড়া ভাঙবে না। আর একটু পর মিষ্টি রোদটা যখন হেসে উঠবে, তখন ঠিক মেনে নেওয়া যাবে ‘কর্মেই মুক্তি’।
শীতের সকালের এমন আলসেমিকে কীভাবে জয় করা যায়, কীভাবেই–বা ভোর হলেই দোর খুলে দেওয়া যায়? শীত-গ্রীষ্ম সারা বছর সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠেন, এমন এক কর্মমুখর নারীর কাছে জানতে চাইলাম সে কথা। রাজশাহীর বাসিন্দা ৭০ বছরের এই নারী নাম জানাতে চাইলেন না। তবে বলে দিলেন তাঁর সূত্রটা। জানালেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর ভোরে ঘুম ভাঙত। সকালে উঠেই চুলায় বসিয়ে দিতেন চায়ের কেটলি। হাত–মুখ ধুয়ে একসঙ্গে চা পান করতেন বাবা আর মেয়ে। বাবার জন্যই উঠতেন তখন। তাঁর মা অত সকালে উঠতে পারতেন না। আজও রয়ে গেছে সেই অভ্যাস। বললেন, ‘অ্যালার্ম লাগে না।’ দেহঘড়িই জাগিয়ে দেয়। সকাল সকাল যেমন ওঠেন, তেমনি ঘুমাতেও যান আগে আগে। রাত ১১টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ঘুম ভাঙার পর আর বিছানায় থাকতে নেই, এটাই মেনে এসেছেন এতগুলো বছর। আর একটা কথা জীবনের মূলমন্ত্র বলে মানেন, ‘যে শুয়ে থাকে, তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে।’ এভাবেই সংসার, শিক্ষকতা, জীবনের যত ঝড় সামলেছেন শক্ত হাতে। শরীর এখন ক্ষীণ হয়েছে। কিন্তু এখনো তেমনই কর্মচঞ্চলতায় কেটে যায় দিন। সকালের চা পানের অভ্যাসটা রয়ে গেছে এখনো।
এবার ছোট্ট রাহাতের গল্প। ঢাকার কলাবাগানের বাসিন্দা আট বছরের রাহাত শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠতে চায় না। তাকে জাগাতে হিমশিম খান মা-বাবা। ‘পউষ এলো গো, পউষ এলো, অশ্রু-পাথার হিম পারাবার পারায়ে’ বাবার মুখে নজরুলের এই কবিতা শুনে পৌষ বা হেমন্তের ভোরে অশ্রুতে ভেসে যায় রাহাত। মা-বাবার ডাকাডাকিতে ঘুমটা ভাঙে বটে, তবে হিমসকালে কানটুপি আর মোজা পরে রিকশায় বসে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মা জানালেন, ছেলের ঘুম ভাঙাতে তারা এক মজার খেলা বেছে নিয়েছেন। তিনজন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ঠিক করে ফেলেন সকালে অ্যালার্ম বাজার পর কে আগে বিছানা ছাড়বে। অ্যালার্ম বাজতেই যে প্রথম বিছানা ছেড়ে কাজ শুরু করতে পারে, সে পায় পুরস্কার। খেলায় জিততে তাই অ্যালার্ম বাজলে রাহাতও হুটোপুটি শুরু করে। খেলায় জিতলে স্কুল থেকে ফেরার পথে মা-বাবা কিনে দেন চকলেট, খেলনা। পুরস্কার পেয়ে বিশ্বজয়ের হাসি দেখা যায় তার মুখে।
অ্যালার্ম যখন অ্যালার্মিং
এসব তো নিজের মতো করে শীতের সকালের লড়াইয়ের কৌশল। এবার শোনা যাক বিশেষজ্ঞ কী বলেন।
রাজশাহীর সেই নারীর দেহঘড়ি পদ্ধতির কথাই বলছেন যুক্তরাজ্যের স্লিপিহেড ক্লিনিকের পরিচালক ও ঘুমবিষয়ক মনোবিদ স্টেফানি রমিসজিওয়েস্কিও। বিবিসির এক প্রতিবেদনে তিনি বলছেন, সপ্তাহের প্রতিদিন একই সময়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে। এমনকি রাতে ভালো ঘুম না হলেও সকালে একই সময়ে জাগতে বলছেন তিনি। বলছেন, এতে প্রতিদিন সকালে একই সময়ে সক্রিয় হতে শিখবে শরীর। একই সময়ে সজাগ হবে মস্তিষ্ক।
স্টেফানি বলেন, অ্যালার্মের শব্দে শরীরে স্ট্রেস হরমোন তৈরি হয়। তাই অ্যালার্ম না বাজিয়ে উজ্জ্বল আলোতে ঘুম ভাঙার অভ্যাস গড়ে তোলার কথা বলছেন এই মনোবিদ। এতে ঘুমভাব উদ্রেককারী মেলোটোনিনের স্তর কমে যায়। ‘আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ’ সেই জানা কথা আবার বলছেন স্টেফানি। প্যাঁচার মতো রাত জাগার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে। স্ক্রিন থেকে থাকতে হবে দূরে।
আলোচনা খটমট মনে হলেও কৌশল কিন্তু মন্দ নয়। বেশি কঠিনও নয়। জানালার ভারী পর্দাটা ঘুমানোর আগেই সরিয়ে দিন, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামকে দিন ছুটি। ঘড়ির কাঁটা মেনে মায়ের বোনা নকশিকাঁথার উষ্ণতায় চলে যান ঘুমের জগতে। আর শুভমিতার ‘যেভাবেই তুমি সকাল দেখ সূর্য কিন্তু একটাই’ সুর ভাজতে ভাজতেই নাহয় সকালটা শুরু করলেন। তাতে শীতের সকালে ঘুম ভাঙার কষ্ট কিছুটা হলেও কমবে।