যেটা ছাড়া কনে সাজ অসম্পূর্ণ
মেহেদি ছাড়া কনের সাজ অসম্পূর্ণ। কয়েক বছর ধরে মিনিমালিস্টিক ধারা স্পর্শ করেছে কনের মেহেদির নকশায়ও।
আগে বাড়ির উঠানে বিভিন্ন গাছের সঙ্গী হয়ে অন্তত একটা মেহেদিগাছ থাকতই। গ্রাম বা মফস্সলের বাড়ির ক্ষেত্রে কথাটা এখনো প্রযোজ্য। বিয়ে উপলক্ষে সদলবল গাছ থেকে তোলা হতো মুঠো মুঠো মেহেদিপাতা। তারপর উঠানে পাটা পেতে সেই পাতা বাটতে বসে যেতেন কনের ভাবি আর সখীরা। দুই হাতের দশ আঙুলে মোটা করে লাগানো হতো সেই পাতার পেস্ট। দুই হাতের চার তালুতে আঁকা হতো বৃত্ত। সেই বৃত্তের আশপাশে কখনো কখনো আবার আঁকা হতো একটু বড় বড় বিন্দু! আর সহজ, সাধারণ এই নকশাই এখনো চলমান ধারা।
টিউব মেহেদি বাজারে আসার পর মেহেদির নকশায় আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিয়ের সাজপোশাকে যতই অভিনবত্ব আসুক, মেহেদি ছাড়া কনের সাজ অসম্পূর্ণ। কিছুদিন আগেও বিয়ের কনেরা কনুইয়ের ওপরেও মেহেদি দিয়েছেন। কনুই ও কবজির মাঝবরাবর পর্যন্ত মেহেদি দেন অনেকেই। মেহেদির নকশার ক্ষেত্রে ফুলের বেজ করে বিভিন্ন রকম ফুল যেমন গোলাপ, টিউলিপ, পদ্মফুলের নকশা আঁকা হয়। তবে এখনো গোল বা মান্ডালা নকশার চলই দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। মান্ডালার সঙ্গে ঝুমকা, চেইন বা অলংকারের নকশা মেলানো যায়। এই ধারায় হাতের তালুতে একটা পানপাতার নকশাও বেশ ট্রেন্ডি। অনেকেই বর-কনের পোর্ট্রেটও আঁকেন মেহেদিতে। হাতের তালুতে আঁকেন বর-কনের ক্যারিকেচার। রাজা-রানিও আঁকেন কেউ কেউ। আর নাম বা নামের আদ্যক্ষর লেখার চল তো আগেও ছিল, এখনো আছে। অনেকে হাতে মেহেদি দিয়ে তাতে ফাঁকে ফাঁকে গ্লিটারও দিচ্ছেন। এ ছাড়া মেহেদি নকশার মধ্যে যেসব ফাঁকা জায়গা থাকে, সেখানে কনের পোশাকের রঙের সঙ্গে মিল রেখে অ্যাক্রিলিক রং দিয়ে আলপনা করার চলও আছে। সে ক্ষেত্রে অ্যাক্রিলিক রঙের গাঢ় ভাব কমিয়ে হালকা করার জন্য এর সঙ্গে কিছুটা অক্সিল ব্যবহার করা ভালো। আরব্য ঢঙে মেহেদি নকশায় কলকি প্রাধান্য পায় বেশি।
কয়েক বছর ধরে ফ্যাশন আর বিউটির মিনিমালিস্টিক ধারা স্পর্শ করেছিল কনের মেহেদির নকশায়ও। তবে বলিউড তারকা আলিয়া ভাট আর পাকিস্তানি অভিনেত্রী মাহিরা খানের বিয়ের পর মেহেদিতেও চলছে মিনিমালিজম হাওয়া। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বলেন, এখনো মেহেদির নকশায় অ্যারাবিক আর মিসরীয় স্টিকই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তবে পুরো হাত ভরে নকশা করাটা এখন আউট অব ট্রেন্ড। কেননা, পুরো হাত ভরে নকশা আঁকলে নকশাটার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা মুশকিল। ফাঁকা জায়গা থাকলে তখনই নকশাটা স্পষ্ট হয়। এ ছাড়া হাত ভরে নকশা করলে কিছুদিন পর যখন সেটা খানিক হালকা হয়ে আসে, তখন হাতের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে যায়।
পাকা রং পেতে
পুরোনো দিনের নকশার সঙ্গে এখনকার নকশায় অনেক পার্থক্য থাকলেও রং পাকা করার কৌশল কিন্তু একই আছে। সেসব কৌশলই আবার মনে করিয়ে দিলেন শোভন। আগেকার মতোই সুন্দর ও দীর্ঘস্থায়ী রঙের জন্য বাটা মেহেদির সঙ্গে চা-পাতা বা লিকার ব্যবহার করা হয়। মেহেদি দেওয়ার পর তুলা দিয়ে হালকা করে লেবু আর চিনির সিরাপ ব্যবহার করতে পারেন। এতে রংটা অনেক গাঢ় বা খয়েরি হয় না। টকটকে একটা লাল ভাব আসে। পেশাদার পারলারে মেহেদি দিতে গেলে সেখানে আগে হাতটা তৈরি করে নেওয়া হয় মেহেদির জন্য। ভালোভাবে ধুয়ে, মুছে, শুকিয়ে একধরনের তেল ম্যাসাজ করা হয়। এরপর আঁকা হয় নকশা। ফলে মেহেদির রং গাঢ় আর দীর্ঘস্থায়ী হয়। মেহেদি তোলার পর হাতে তাপ লাগাতে পারেন। আর প্রথম ৪৮ ঘণ্টা পানি যত কম লাগানো যাবে, ততই ভালো।
মেহেদি অনুষ্ঠান
এটা বিয়ের মুখ্য চারটি আয়োজনের মধ্যে অন্যতম। গালভরে ডাকা হয় কনের (অমুকের) মেহেদিছোঁয়া। গ্রামে সেই উৎসব হয় উঠানে। শহরে দালানের ছাদে। ছাদ না থাকলে অন্দরেই। ‘মেহেদিছোঁয়া’ উপলক্ষে কনে ভালোভাবে স্নান করে, খেয়ে, পোশাক পরে তৈরি হয়ে নেন। মেহেদির অনুষ্ঠানে কনেরা লেহেঙ্গা, আনারকলি, গারারা, শারারার মতো এথনিক পোশাকে ও সাজে দেখা দেন। অনেকে আবার শাড়িও পরেন। কনের মেহেদিছোঁয়া উপলক্ষে আগের রাতে আঁকা হয় আলপনা। ফুল, বেলুন, ফিতা, কাগজের নকশায় সেজে ওঠে জায়গাটুকু। মেহেদিসন্ধ্যায় কনের পোশাকের রঙে প্রাধান্য পায় সবুজ। কনের সখীরাও একই ধরনের সাজপোশাকে থাকেন। মেহেদি উৎসবে বাজানোর জন্য তৈরি হয় আলাদা গানের তালিকা। একটার পর একটা গান বাজতে থাকে। প্লেট থেকে শিঙাড়া, সমুচা, পাকোড়া উধাও হতে থাকে। অনেকেই রাখেন ফুচকাও। চায়ের কাপ থেকে চা ফুরাতে থাকে। অনেকের চা চুপিসারে ঠান্ডা হয়ে যায় চুমুকের অভাবে। ঝুপ করে নামে সন্ধ্যা। তখন লাইটিং আর মানুষের সমাবেশ ও আড্ডায় জমে ওঠে মেহেদি উৎসব। একে একে কনের সখীদের মনও রাঙিয়ে যায় মেহেদির রঙ।