সৌন্দর্যচর্চায় দেশীয় পণ্য কিনে হই ধন্য
তিব্বত, কসকো, গন্ধরাজ ইত্যাদি পুরোনো নামগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনের নানা স্মৃতি। অতীতে এগুলো ছিল বাংলাদেশে ব্যবহৃত মূল সৌন্দর্যপণ্য। এখনো সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহার করা হচ্ছে এসব পণ্য। পুরোনো পণ্যগুলোর সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন প্রসাধনী।
বিশ্বজুড়ে প্রসাধনীর বাজার অনেক বড়। সংখ্যাটা রীতিমতো চোখ কপালে তোলার মতো। এই বাজার আরও বাড়াতে বিশেজ্ঞরা আঁটছেন নতুন নতুন ফন্দি, অবলম্বন করছেন নানা পন্থা। এই ইঁদুরদৌড়ের বাইরে আমরাও নই। আমাদের দেশের প্রসাধনীর বাজারটাও উল্লেখযোগ্য। এই বাজারে দেশি প্রসাধনী বা সৌন্দর্যপণ্যের অবস্থানটা কোথায়, তারই কিছুটা ধারণা দিতে এই লেখা। সৌন্দর্যপণ্যের শ্রেণিবিভাগটা জানা থাকলে এই হিসাব বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।
প্রসাধনী বা সৌন্দর্যপণ্যকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. কালার কসমেটিক, ২. সাধারণ ত্বকচর্চা আর ৩. মেডিকেটেড ত্বকচর্চা।
কালার কসমেটিকসের আওতায় পড়ে মেকআপ ও মেকওভারের জন্য প্রয়োজনীয় সৌন্দর্যপণ্য। এই তালিকায় রয়েছে ফাউন্ডেশন, কনসিলার, ফেসপাউডার, লিপস্টিক, মাসকারা, আইলাইনার, ব্লাশ ইত্যাদি। মুখমণ্ডলের নানা অংশ, যেমন চোখ, নাক, ঠোঁট, গাল, চিবুক ছাড়াও হাত, নখ ইত্যাদির সৌন্দর্যবর্ধনে এসব ব্যবহৃত হয়।
এরপর আসে সাধারণ ত্বকচর্চা। নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখতে এসব পণ্য আমাদের প্রতিদিনের জীবনে প্রয়োজন। এই তালিকাও নেহাত ছোট নয়—সাবান, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, তেল, লোশন, ক্রিম, সুগন্ধী, পেট্রোলিয়াম জেলি, ট্যালকম পাউডার ইত্যাদি।
মেডিকেটেড ত্বকচর্চার তালিকায় আছে নানা ধরনের ক্রিম, সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি, যা চিকিৎসকেরা বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে হারবাল পণ্য, অরগানিক ও রাসায়নিকমুক্ত পণ্য।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে সৌন্দর্যপণ্যের বর্তমান বাজার বেশ আকর্ষণীয়। অ্যালায়েড মার্কেট রিসার্চের একটি গবেষণা বলছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত এটা ছিল ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেটা ২০২৭ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ২ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২৭ সালে এর যৌগ বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১। আরও আশা জাগানো বিষয় হলো, এই খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা ২০২০-২৭ পর্যন্ত অন্তত ৯৬০ মিলিয়ন ডলার।
জানামতে, কালার কসমেটিক আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় না। হয়ে থাকলেও মানসম্মত নয়। মেডিকেটেড স্কিনকেয়ার পণ্যের অবস্থাও তথৈবচ। দু-একটা আছে, সেগুলোর ওপরও খুব একটা নির্ভর করা যায় না। আমাদের শক্তির জায়গাটা হলো সাধারণ ত্বকচর্চার বিভাগ (জেনারেলাইজড স্কিনকেয়ার ক্যাটাগরি)। বলা যায়, ছয় থেকে সাতটি স্থানীয় কোম্পানি এই খাতের ৯৫ ভাগ বাজার নিজেদের দখলে রেখেছে। এর মধ্যে অন্তত ৬০ ভাগ ইউনিলিভারের আওতায় রয়েছে। এর পরেই আছে স্কয়ার টয়লেট্রিজ, কোহিনুর কেমিক্যালস, কেয়া কসমেটিকস, অ্যারোমেটিক কসমেটিক ইত্যাদি। তবে এসব প্রতিষ্ঠান স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদন করলেও কাঁচামালের জন্য নির্ভর করে অন্য দেশের ওপর। ৯০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। অনেকে আবার বিদেশে পণ্য তৈরি করে দেশে নিয়ে এসে কেবল প্যাকেজিং করে।
আমাদের নিজেদের পণ্যের কথা উঠলেই কিছু নাম স্মৃতিমেদুর করে। বিশেষ করে শীতকালে কিছু নাম বেশি করে মনে পড়ে। কারণ, একটা সময়ে গ্লিসারিন সাবান বলতেই ছিল কসকো। প্রতিষ্ঠানের নাম আমরা মনেই রাখিনি। কমান্ডার সোপ কোম্পানি লিমিটেড। সত্তরের দশকের পর থেকে এই সাবান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এটাকে বলা হতো কসকো ট্রান্সপারেন্ট গ্লিসারিন সাবান। এই সাবানের জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে এ নিয়ে ছড়াও চালু হয়েছিল: ...বড় আপুর বিয়ে/ কী কী দিয়ে/ ‘কসকো’ সাবান দিয়ে...। এ প্রতিষ্ঠানের আরও একটি সাবান ছিল—কসকো কোল্ড ক্রিম সোপ। তবে সঠিক ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে এই সাবান এখন কেবল স্মৃতির অংশ হয়ে গেছে। আর ক্বচিৎ দেখা যায় রেস্তোরাঁগুলোয়।
এই শীতের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি সৌন্দর্যসঙ্গী পমেড বা পেট্রোলিয়াম জেলি। এ ক্ষেত্রে আদি ও অকৃত্রিম তিব্বত পমেড। এটা কোহিনূর কেমিক্যালসের। এই প্রতিষ্ঠানের আরও একটি পুরোনো অথচ গুণমানে চমৎকার পণ্য হলো তিব্বত স্নো। এ ছাড়া আছে তিব্বত লাক্সারি সাবান ও ট্যালকম পাউডার, স্যান্ডেলিনা সাবান, বিউটিনা ফেসওয়াশ, বডি লোশন ও হেয়ার অয়েল। লিপবাম, পেট্রোলিয়াম জেলি, ঘামাচি পাউডারও আছে। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠা কোহিনূর কেমিক্যালসের। তবে ১৯৮৮ সালে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
আবার ঘামাচি পাউডারের কথা উঠলে মিল্লাত ঘামাচি পাউডারের নাম করতেই হবে।
যা–ই হোক, নব্বইয়ের দশক তখন শুরু। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমা করে সুপারহিট নবাগত মৌসুমী। তরুণদের হৃদয়হরণকারী। সেটা সম্ভবত ১৯৯৪ সাল। বাজারে এল মেরিল স্প্রিং রেইন শ্যাম্পু। বোধ করি সেটাই বাংলাদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের তৈরি প্রথম কন্ডিশনারসহ শ্যাম্পু। বাজারে আনে স্কয়ার টয়লেট্রিজ। আর ওই শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন করেছিলেন মৌসুমী। ঝলমলে চুলে সাদা পোশাকে তিনি ছিলেন অনন্যা। সেই শ্যাম্পু এখন আর নেই। তবে স্কয়ারের পণ্যের বৈচিত্র্য আর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের পণ্যতালিকায় আছে রিভাইভ ব্র্যান্ডের ট্যালকম পাউডার, লোশন ও শ্যাম্পু, মেরিল ব্র্যান্ডের মিল্ক সোপ, পেট্রোলিয়াম জেলি, লিপবাম, অলিভ অয়েল, লিপজেল, গ্লিসারিন, জুঁই নারকেল তেল, কুল ব্র্যান্ডের ডিওডোরেন্ট বডি স্প্রে, শেভিং ফোম, শেভিং ক্রিম আর আফটার শেভিং জেল ও লোশন। এ ছাড়া আছে মেরিল ব্র্যান্ডের বাচ্চাদের সাবান, শ্যাম্পু, লোশন ইত্যাদি। তাদের তালিকায় যোগ হয়েছে রেইন শাওয়ার জেল।
নব্বইয়ের দশকে আরও একটি শ্যাম্পু ধূমকেতুর মতো উদয় হয়েই মিলিয়ে যায়। নাম বাউন্স। এটা বাংলাদেশি কি না, সেটাও এখন আর বলা সম্ভব নয়। তবে মনে থাকার কারণ এর চটকদার বিজ্ঞাপন। যেখানে সাদিয়া ইসলাম মৌয়ের সঙ্গে আরও একজন ছিলেন।
কাছাকাছি সময়ে বাজারে শোরগোল ফেলে দেয় একটি সাবানের বিপণনকৌশল। ১৯৯৩ সালে যমুনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান অ্যারোমেটিক কসমেটিকের প্রতিষ্ঠা। শুরুতেই তারা বাজারে আনে অ্যারোমেটিক সাবান। তাঁর ইউনিক সেলিং পয়েন্ট বা ইউএসপি ছিল একটি শব্দ—হালাল। সেই সময় সেটা অভিনবই কেবল নয়, ইনোভেটিভও ছিল। সাবানটি তখন কেবল বাংলাদেশ নয়, পার্শ্ববর্তী ভারতেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বাংলাদেশে তখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল লাক্স। এর মার্কেট শেয়ারে ভাগ বসিয়ে ১৪ শতাংশ দখল করে নেয় তারা। শুরুতে ওই সাবানের সব ধরনের বিজ্ঞাপনের মুখ হয়ে ওঠেন নবাগত রুমানা। সেই সময়ে রুমানা হয়ে ওঠেন আরেক হার্টথ্রব।
১৯৯৬ সালে আসে আরও একটি কোম্পানি—কেয়া কসমেটিকস। বাজারে আসে নানা পণ্য। এর মধ্যে বেশি জনপ্রিয়তা পায় কেয়া সাবান। মৌ ও নোবেল ছিলেন পণ্যদূত।
এরই কাছাকাছি সময়ে আরও একটি প্রতিষ্ঠান বাজারে আনে ম্যাগনোলিয়া সাবান। একাধিক সৌরভের। কোথাও মুদ্রিত থাকত না ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এই সাবানের সিংহভাগ রপ্তানি হতো ভারতে।
একসময় জিল লিমিটেডের লিলি সাবানও ছিল বাজারে। কিন্তু এখন আর চোখে পড়ে না। এটাই আসলে আমাদের ব্র্যান্ডগুলোর দুর্ভাগ্য। বিদেশে আমরা দেখি, বছরের পর বছর ধরে টিকে থাকে পণ্য, উদ্যাপন করে শতবর্ষ, দ্বিশতবর্ষ। অথচ আমাদের এখানে ঝলক দেখিয়েই মিইয়ে যায়, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না।
আশার কথা দিয়ে শেষ করি। শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশে কোনো কালার কসমেটিক তৈরি হয় না। এই চিত্র বদলাতে এগিয়ে এসেছে রিমার্ক। এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম ২০২০ সালে। তবে তারা এখনো উৎপাদনে যায়নি। বরং গবেষণা ও পণ্য উন্নয়নকেই গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। জানা গেছে, এ বছরই তারা বাজারে আনবে বাংলাদেশে তৈরি পণ্য। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় তাদের কারাখানা। নিওর ব্র্যান্ড নামে এখানে তৈরি হবে সাধারণ কালার কসমেটিকস। আবার হার ল্যান হবে এক্সক্লুসিভ কালার কসমেটিকস। জেনারেলাইজড স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট ব্লেজ ও স্কিন আর মেডিকেটেড স্কিনকেয়ার পণ্য সিওডিল ব্র্যান্ড নামে আসবে। ফলে একেবারে সাবান-শ্যাম্পু থেকে শুরু থেকে মেকওভারের নানা পণ্য এখন থেকে বাংলাদেশেই তৈরি হবে।