অনেক চড়াই–উতরাই পেরোতে হলেও মেডিকেলের প্রতিটা মুহূর্তই উপভোগ করেছি
কদিন পরই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। এটিকে সামনে রেখে বর্তমানে মেডিকেল পড়ুয়ারা স্বপ্ননিয়েকে জানিয়েছেন এই পেশার প্রতি তাঁদের আবেগ, অনুভূতির কথা। শুনিয়েছেন ক্যাম্পাসের অভিজ্ঞতা, মেডিকেলে পড়তে আসার অণুপ্রেরণার গল্প।
এস এম জাহিন জাওয়াদ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমার জীবনে আদর্শ ছিল দাদু। তিনি ছিলেন খুলনা মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক, পেয়েছিলেন জাতীয় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের পুরস্কার। ছোট থেকেই তাই শিক্ষক হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল। তবে ধীরে ধীরে মানবদেহের জটিল বিষয়গুলো নিয়েও আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। প্রথম যখন আব্বুর রক্তচাপ মাপা শিখি, তখন থেকেই এ ব্যাপারে আলাদা আগ্রহ কাজ করত।
শিক্ষার্থী হিসেবে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। ঢাকা মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন ছিল। বলতে লজ্জা হলেও স্বপ্ন দেখতাম, সারা দেশ আমাকে চিনবে। কিন্তু সে স্বপ্নের পথে প্রথম ধাক্কা খেলাম, যখন ফলাফলে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে চান্স হলো। তবে বরাবরই আমি আশাবাদী মানুষ। ভাবতে থাকি, মাইগ্রেশনে ইনশা আল্লাহ চলেই আসব। ঢাকা মেডিকেল কলেজে হয়েও যায়। তবে মিটফোর্ড আমার জীবনে অন্যতম সেরা অধ্যায়। করোনায় মাইগ্রেশনে দেরি হওয়ায় ছয় মাস ছিলাম মিটফোর্ডে। এ সময়ে পেয়েছি অনেক অকৃত্রিম বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী সিনিয়র এবং মাতৃসম শিক্ষক।
চান্স পাওয়ার পর প্রথম সাদা অ্যাপ্রন গায়ে জড়ানোর অনুভূতি অন্য রকম। তৃতীয় বর্ষে গলায় স্টেথোস্কোপ জড়িয়ে যখন ওয়ার্ডে যাওয়া শুরু করলাম, তখন সেটি আরও তীব্র হলো।
ঢাকা মেডিকেলে এসে বেশ সহজে মানিয়ে যাই। মেডিকেল–জীবন কখনোই সহজ থাকে না। অনেক চড়াই–উতরাই পেরোতে হলেও প্রতিটা মুহূর্তই উপভোগ করেছি। ঘুমচোখে লেকচারে মন না বসলেও আইটেম, কার্ড, টার্ম, প্রফের আগে ঘুম হারাম করে ঠিকই পড়েছি। পড়ার চাপে হোক বা বয়সে, দুরন্তপনা একটু কমেছে হয়তো। আর তো বাকি দুটি প্রফ। নিজেকে মানসম্মত চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের গড়ে তুলতে চাই।
রোগীরাই আমার অনুপ্রেরণা
হালিমা তুস সাদিয়া
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল
ছোটবেলায় আমার পছন্দের বিষয় ছিল গণিত। আর অপছন্দের জীববিজ্ঞান। তাই মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর জটিল পড়াগুলো বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছে। এরপর তো মানবকঙ্কালের বিভিন্ন অংশ (হাড়) বই–খাতার মতোই নিত্যসঙ্গী হয়ে গেল। আইটেম, কার্ড, টার্ম, প্রফের চাপ; ডিসেকশন হলে ক্যাডাভারের (মৃতদেহ) বিকট গন্ধ আর পোস্টমর্টেমের মধ্যে জীবন ফিকে হতে শুরু করল। কঙ্কাল, লাশ নিয়ে দুঃস্বপ্নও দেখেছি। এসবের মধ্যেই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রফ পাস করে গেলাম। প্রফের সময় কী পরিমাণ চাপ নিয়ে পরিশ্রম করতে হয়, সেটা প্রফ না দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এত বড় সিলেবাসে উত্তীর্ণ হতে লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিকে আলাদাভাবে ৬০ শতাংশ করে নম্বর পেতে হয়। তাই সপ্তাহের ব্যস্ততা শেষে বৃহস্পতিবার রাত আমাদের জন্য চাঁদরাতের মতো।
চান্স পাওয়ার পর প্রথম সাদা অ্যাপ্রন গায়ে জড়ানোর অনুভূতি অন্য রকম। তৃতীয় বর্ষে গলায় স্টেথোস্কোপ জড়িয়ে যখন ওয়ার্ডে যাওয়া শুরু করলাম, তখন সেটি আরও তীব্র হলো। শেষ বর্ষে ক্লিনিক্যাল বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহ প্রবল হয়েছে। কারণ, এখন প্রতিটি রোগীর ভেতর আমার প্রিয় গণিত খুঁজে পাই। তারা যে লক্ষণ নিয়ে আসেন আর আমি পরীক্ষা করে যা পাই, দুটি মিলে একটা সমীকরণ গঠিত হয়। আমার কাজ হচ্ছে ‘এক্স’–এর মান বের করা অর্থাৎ রোগনির্ণয়। তারপর পরীক্ষাগারের সাহায্য নিয়ে বাঁ পক্ষ ও ডান পক্ষ মেলানো। কোনো কারণে যখন হতাশা চলে আসে, তখন রোগীদের অসহায় চেহারা আমাকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়। মনে পড়ে মেডিকেল কোড অব কনডাক্টের প্রথম লাইন, ‘আই সলেমলি প্লিজ টু ডেডিকেট মাই লাইফ টু দ্য সার্ভিস অব হিউম্যানিটি।’