রিকশাচিত্র যেভাবে আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গী হলো
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকা শহরের ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’। আজ বুধবার ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তসরকারি কমিটির ১৮তম অধিবেশনে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে রিকশা ও রিকশাচিত্র বৈশ্বিক বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেল। বাহন হিসেবে রিকশা বাঙালির কাছে জনপ্রিয় বহু আগে থেকে। কিন্তু রিকশাচিত্রের নকশা কীভাবে প্রবেশ করল ফ্যাশন আর জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে, তা–ই জানুন এই লেখায়। ২০১১ সালের ২২ মার্চ এই লেখা প্রকাশিত হয় ‘প্রথম আলো’র ক্রোড়পত্র ‘নকশা’য়। লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হলো।
কেবল যাতায়াতের প্রয়োজনেই যাঁরা অগত্যা তিন চাকার রিকশায় চেপে বসেন, তাঁদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে হয়তো। কিন্তু সত্যিকার দেশীয় শিল্পের কদর যাঁরা বোঝেন, তাঁদের কাছে রিকশার সৌন্দর্য আলাদা করে চোখে পড়তে বাধ্য।
ঝকমকে নতুন রিকশার যে ঝলমলে রূপ, তার যে অঙ্গসজ্জা, এর সঙ্গে নাকি তুলনা চলে কেবল নববধূর রূপসজ্জারই। আর রিকশার সবচেয়ে রংদার জায়গাটা কী? ঠিক ধরেছেন, রিকশা আর্ট বা রিকশাচিত্রই আসলে বাংলাদেশের রিকশার আসল সৌন্দর্য। রিকশার পেছনের এই এক চিলতে জায়গাটুকুকেই তাঁদের একান্ত নিজস্ব ঘরানার শিল্পচর্চার জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছেন রিকশাচিত্রের চিত্রকরেরা।
ঢাকার রাস্তা থেকে রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার দাবিটা জোরালো হয়ে উঠছে। রিকশার পেছনের ঝলমলে ওই সব চিত্রও আজকাল কমই দেখা যায়। ভালো নেই চিত্রকরেরা। অনেকেই পেশা বদল করছেন। তবে কি হারিয়ে যাবে ঢাকার এই ঐতিহ্য? মনে হয় না। কারণ এই চিত্রের বদল বা ট্রান্সফরমেশন ঘটছে। আমাদের জীবনযাত্রার নানা অনুষঙ্গে উঠে আসছে রিকশাচিত্র। রিকশায় হয়তো থাকবে না, তবে সৌন্দর্যপ্রিয় কিছু মানুষ আর দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোর উদ্যোগে পোশাক, ঘর সাজানোর উপকরণ এবং ঘরের দেয়ালে রয়ে যাবে এই চিত্র। এমনই মনে করছেন রিকশাচিত্র নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা।
ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল অনেক দিন ধরেই এই মাধ্যম নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর ফ্যাশন হাউস বিবি প্রোডাকশনের পণ্যগুলোতে এর ছাপ স্পষ্ট। কাঠের চুড়ি, ব্যাগ, ঝুড়ি, ফতুয়া ইত্যাদিতে অলংকরণ হিসেবে দেখা যায় রিকশাচিত্রের নানা মোটিফ।২০০৮ সালের বৈশাখে ফ্যাশন হাউস রঙ এনেছিল রিকশাচিত্রের ব্যবহারে তৈরি পোশাক। শাড়ির আঁচল, পাঞ্জাবির গলায় ব্যবহার হয়েছিল উজ্জ্বল এসব চিত্র। এখনো রঙ এ নিয়ে কাজ করছে। রঙের টি-শার্টেও ব্যবহার হয়েছে রিকশাচিত্র, যা তরুণেরা গ্রহণ করেছে সাদরে। ফ্যাশন হাউস যাত্রা শুরু থেকেই কাজ করছে রিকশাচিত্র নিয়ে। এ বছর যাত্রার বৈশাখী সংগ্রহের পুরোটাই সাজানো হবে রিকশাচিত্রকে থিম ধরে, জানালেন যাত্রার মহাব্যবস্থাপক আনুশেহ আনাদিল। রিকশার পেছন থেকে আমাদের জীবনযাত্রায় এই শিল্প তুলে ধরার অনুপ্রেরণা পেলেন কীভাবে—এই প্রশ্নে আনুশেহ বললেন, ‘গানের চেয়ে বরং ক্র্যাফটেই আমি বেশি আগ্রহ পাই। আমার একসময় মনে হয়, আমাদের দেশে যেসব ক্র্যাফট তৈরি হয়, তা খুব নিষ্প্রাণ। অথচ আমাদের রাস্তাঘাট কী উজ্জ্বল! রিকশাআর্ট, ট্রাকআর্ট কী দারুণ ঝলমলে। আর আমি মনে করি, বাংলাদেশের পরিচয়ও এটাই। বাংলাদেশ এমনই উজ্জ্বল, বৈচিত্র্যময়। এই রংচঙে ভাবটাই ক্র্যাফটেও আনতে চেয়েছি। এ নিয়ে অনেক আগে থেকেই কাজ করতাম। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। বিবি খালার (বিবি রাসেল) সঙ্গেও কাজ করেছি। এখন নিজের ফ্যাশন হাউস যাত্রার মাধ্যমে করছি।’রিকশাচিত্রের এই রংচঙে ভাবটাই নাকি এর মূল আকর্ষণ। আনুশেহর কথায়, ‘ভাইব্র্যান্ট, ইউথলাইক, ক্রেজি।’
আর্টের সৌন্দর্য, নান্দনিকতা—এসবকেও তাই ছাপিয়ে যায় এর মজাটা। আর পপ আর্টের আসল বৈশিষ্ট্য কিন্তু এটাই। আনুশেহ বলেন, ‘আমাদের রিকশাচিত্রকরেরা কী অনায়াসে বানিয়ে ফেলেন একেকটি চিত্র। অনেক স্বতঃস্ফূর্ত তাঁদের কাজের ধরন। আর আমিও অনেকটা এমনই। যেকোনো আর্টকে দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে তুলে আনা যায়, সেটা নিয়ে ভাবি। জীবন ও শিল্প এক করে ফেলার উপায় খুঁজি। এটাই ক্র্যাফট নিয়ে কাজ করার মজা। ’লিটন শাহ আগে কাজ করতেন রিকশাচিত্রকর হিসেবে। এখন যাত্রার ডিজাইন দলের সদস্য। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। রিকশাচিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘রিকশাচিত্রের টানগুলো খুব স্পষ্ট। ছোট ছোট নিখুঁত টান, রং খুব উজ্জ্বল। বেশির ভাগ শিল্পীই নিজে নিজে শেখেন। নিজের কল্পনা কাজে লাগিয়ে আঁকেন।’তিনি জানান, যাত্রায় বেশির ভাগ পণ্যেই রিকশাচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
আছে ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ, কুশন কভার, পর্দা, ফাইল, স্যান্ডেল ইত্যাদি। রিকশায় অনেক সময় বাংলা সিনেমার অভিনয়শিল্পীদের ছবি ব্যবহার করা হয়। সেসব দিয়েও তৈরি হয়েছে ব্যাগ, ছবির ফ্রেম। রিকশার হুডের নকশা ব্যবহার করে করা হয়েছে বইয়ের তাক। এ ছাড়া রিকশার সিটটাকেই ব্যবহার করা হয়েছে বসার জায়গা হিসেবে। টেবিলের পুরোটা জুড়েই করা হয়েছে রিকশাচিত্র। এ ছাড়া যাত্রার আছে একদল রিকশাচিত্রকর, যাঁরা ফরমায়েশ পেলে বাড়িতে গিয়েও রিকশাচিত্র করে দেবেন। ধরুন, আপনার বসার ঘরের একদিকের দেয়ালজুড়ে রিকশাচিত্র করাতে চান, তাহলে তাঁদের সাহায্য নিতে পারেন। ইদানীং অনেক স্কুলে, শিশুর ঘরেও এভাবে রিকশাচিত্র করানো হচ্ছে।