আমার জীবন রক্ষাকারী কাচের বোতলটি মা ৫০ বছর আগলে রেখেছিলেন
সময় পেলে আজও আমি মা–বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। মে মাসের মাঝামাঝি নৌকায় করে খুলনার দাকোপের সাহেবেরআবাদ থেকে আমরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদে পৌঁছাই। তখন সেখানে ডায়রিয়া আর কলেরার প্রবল প্রকোপ। জেঠাতো ভাই বিভাসসহ তিন আত্মীয় কলেরায় মারা যাওয়ার পর মুমুর্ষূ অবস্থায় আমাকে টাকি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আমার জীবনের আশা ছিল না। হাসপাতালের যেখানে লাশ রাখা হতো, তার পাশেই ছিল আমার শয্যা। আমাকে চার বোতল শিরার স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল। হাসপাতাল ছাড়ার সময় সন্তানের জীবন রক্ষাকারী কাচের বোতলটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন মা।
হাসপাতাল ছাড়ার পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার আগপর্যন্ত আমাদের পরিবার পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত, নিউ ব্যারাকপুর, রানাঘাট ও চাঁদপাড়ায় থেকেছে। কিন্তু কাচের বোতলটি লটবহরের সঙ্গেই ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের বাড়ি ভেঙেছে দুবার। ৫০ বছরে ভাঙেনি সেই কাচের বোতল। যক্ষের ধনের মতো কাচের বোতলটি আগলে রেখেছেন মা।
বড় হওয়ার পর জীবন রক্ষাকারী কাচের বোতলটি আমার স্মৃতিতে আর ছিল না বললেই চলে। স্কুল পেরিয়ে রাজধানীতে এসে নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বোতলটির কথা আমার মনে পড়েনি। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গেছি, হয়তো চোখে পড়েছে কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে বোতলটির দিকে তাকাইনি।
প্রথম আলোতে সাংবাদিকতা শুরু করার পর স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ শুরু করি। ডায়রিয়া, কলেরা, খাওয়ার স্যালাইন, কলেরার টিকা নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন করি। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ডায়রিয়া, কলেরা নিয়ে কী গবেষণা করেছে, কী উদ্ভাবন করেছে, তা নিয়ে আমার ব্যাপক আগ্রহ ছিল ও আছে। ওরস্যালাইন উদ্ভাবনের ৫০ বছর নিয়ে আমি প্রতিবেদন করেছিলাম। এসব করতে গিয়ে একাত্তরের শরণার্থীশিবিরে কলেরার প্রকোপ, মৃত্যু, স্যালাইনের ব্যবহার নিয়ে আমার কিছু ধারণা হয়। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইডের আঞ্চলিক পরিচালক ডা. খায়রুল ইসলাম তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, একাত্তর সালে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে কলেরায় অনুমিত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১৭ হাজারের বেশি।
এসব কাজ করার সময় প্রথম বোতলটির কথা আমার মনে পড়ে। মুঠোফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে বোতলটির কথা জানতে চাই। মা বলেন, বোতলটি আছে। একসময় বোতলটি ঢাকায় আনতে চাই। বড় বোনের হাতে করে বোতলটি ঢাকায় পাঠিয়ে দেন মা।
তারপর কাচের বোতলটি যতবার হাতে নিয়েছি, চোখে জল এসেছে। বারবার মায়ের কথা ভেবেছি। বারবার ভেবেছি, কী করে সম্ভব হলো, মা কী করে পারলেন।
বোতলটি ঢাকার বাসায় ঢোকার পর ভয় বেড়ে গেল—ভেঙে যাওয়ার ভয়। মায়ের হাত আর আমাদের হাত এক নয়। আমার স্ত্রী আর আমার ছেলে খুব সাবধানে বোতলটি ধরতেন। একপর্যায়ে নরম কাপড় দিয়ে মুড়ে বোতলটি নিরাপদ জায়গায় রাখলাম, যেখানে কারও চোখ না পড়ে, হাত না পৌঁছায়। শুধু আমার কাছে নয়, আমার পরিবারের সবার কাছে বোতলটি এক মহামূল্যবান সম্পদ।
এ বছর আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাস্থ্য, চিকিৎসা এবং চিকিৎসকদের ভূমিকা নিয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন ডা. খায়রুল ইসলাম। অনুষ্ঠানের বেশ কয়েক দিন আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ওই মহামূল্যবান বোতলটি আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে স্মারক হিসেবে দিতে রাজি কি না।
আমি একবাক্যে রাজি হইনি। মা, বাবা, বড় বোন, ছোট বোন, আমার স্ত্রী ও আমার ছেলে প্রত্যেকের সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলি। প্রত্যেকেই একবাক্যে রাজি হয়ে যান। আমার ও আমার পরিবারের সম্মতির কথা ডা. খায়রুল ইসলামকে জানাই।
একাত্তরে ভারতের হাসপাতালগুলোতে ব্যবহৃত শিরায় দেওয়া স্যালাইনের কাচের বোতলটি আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসের অনুষ্ঠানে আমি তুলে দিই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্যসচিব সারা যাকেরের হাতে। বোতলটি স্মারক হিসেবে সংরক্ষণ করবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেওয়ার পর বোতলটির প্রতি মায়া বেড়ে গেছে। ১৯৭১ সালে শরণার্থীজীবনের প্রথম অধ্যায়ে বোতলটি আমার জীবন রক্ষায় কাজে লেগেছিল। ৫০ বছর মা তাঁর শক্ত হাতে বোতলটি আগলে রেখেছিলেন।
আজও বোতলটির জন্য আমার পরান পোড়ে।