বিড়ালটি যেভাবে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা গেল
প্রেরণা, প্রতীক্ষা, প্রচ্ছদ। তিন ভাই–বোন। অনেক বিষয়েই তিনজনের মধ্যে বেশ অমিল। তবে একটা বিষয়ে তিনজনের ব্যাপক মিল। তিনজনই ‘পাখি’–অন্তঃপ্রাণ। এই পাখি কিন্তু সেই পাখি না। ফুটফুটে সুন্দর একটা বিড়াল। প্রতীক্ষা তার এক বান্ধবীর বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে এসেছে। সে এখন তাদের বাড়িরই আরেক সদস্য।
প্রেরণা–প্রতীক্ষার অনেক দিনের ইচ্ছা, একটা বিড়াল পুষবে। সদ্য প্রসূত একটা ছানার খোঁজ পেয়েও গেল তারা। কিন্তু বাদ সাধলেন তাদের মা। কোনোভাবেই তিনি বাড়িতে বিড়াল আনতে দেবেন না। ওদের বাবারও ঠিক সম্মতি নেই। তারপরও বিড়ালটাকে কীভাবে বাড়িতে আনা যায়, ফন্দি-ফিকির আঁটতে শুরু করল তারা।
গান গাইতে একবার ঢাকার বাইরে গেছেন ওদের মা। এই ফাঁকে তিন ভাইবোন বাবাকে পটিয়ে নিয়ে গেল প্রতীক্ষার সেই বান্ধবীর বাড়ি। প্রতীক্ষা বলল, বাবা পাঁচ মিনিট বসো, আমরা যাব আর আসব। বাবা ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। একটু পর হইহই করতে করতে তিন ভাইবোন গাড়িতে এসে বসল। বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, প্রতীক্ষার কোলে ফুটফুটে একটা বিড়ালছানা। তিনি আর কিছু বললেন না। গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
মা বাড়ি এসে দেখেন, বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ। একটা বিড়ালছানাকে নিয়ে বসে আছে তিন ভাইবোন। কেন জানি তিনিও আর কিছু বললেন না।
প্রতীক্ষা বিড়ালটির নাম দিল পাখি। পাখিমণি। সেই থেকে এ বাড়ির ষষ্ঠ সদস্য হয়ে আছে পাখি। প্রেরণা-প্রতীক্ষার ঘরেই থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা। যত্ন–আত্তিরও কমতি নেই। পাখি একটু অসুস্থ হলে মনে হতো, ওদের ছোট ভাইটিই বুঝি অসুস্থ। পাখিকে নিয়ে পেট ডক্টরের কাছে ছোটা। মাঝে একবার পাখিকে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। তিন ভাইবোনের প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
পুরো বাড়ি তোলপাড় করে অবশেষে খাটের নিচে এক কোনায় পাখিকে পাওয়া গেল।
পাখির কী হবে
দিন যায়। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায় পুরো পরিবার। শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার তোড়জোড়। কিন্তু পাখির কী হবে। তিনজনেরই ইচ্ছা, পাখি তাদের সঙ্গে যাবে। বাদ সাধলেন বাবা, এখনই পাখিকে নেওয়া যাবে না। আগে নিজেরা গুছিয়ে নিই, পরে দেখা যাবে। অনেক বোঝানো হলো। কিন্তু ওরাও অনড়, পাখি ছাড়া যাবে না।
বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েরা কথা বন্ধ করে দিল। বাড়িতে একটা থমথমে পরিবেশ। শেষে বাবা ওদের কথা দিলেন, আগে বাসা ঠিক করে উঠি। তারপর পাখিকে নেওয়া হবে। তাতেও তারা রাজি নয়। তখন ওদের মা বললেন, ‘আমি তো এবার তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি না। আমি যখন যাব, পাখিকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’ এই প্রস্তাবে তাদের সম্মতি পাওয়া গেল।
শুরু হয় ‘পাখি’কে নেওয়ার প্রস্তুতি। বাবা বা মা পরে যাতে কোনো অজুহাত তুলতে না পারেন, তার জন্য যাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে প্রেরণা। বিভিন্ন এয়ারলাইনসে ই-মেইল করে। সব এয়ারলাইনস পোষা প্রাণী নেয় না। যারা নেয়, তাদের কী কী চাহিদা, জেনে নেয় প্রেরণা। প্রথমেই লাগবে এনওসি (অনাপত্তি সনদ)। এটি হোমবাউন্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা যায়। এরপর মাইক্রোচিপিং। দেখতে সিম কার্ডের মতো কিন্তু আকারে তার চেয়ে ছোট একটা চিপ বিড়ালের ঘাড়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। এই চিপের একটা নির্দিষ্ট নম্বর থাকে। এই নম্বরটিই ওই বিড়ালের পরিচিতি। অনলাইনে এই নম্বর নিবন্ধন করতে হয়। সেখানে পোষা প্রাণীর মালিকের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর থাকে। দেশের বাইরে কুকুর-বিড়াল নিয়ে গেলে এই নম্বর প্রয়োজন পড়ে। কেন জানেন? ধরুন, আপনার পোষ্য হারিয়ে গেল। তখন কেউ যদি একে খুঁজে পায় আর কোনো প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে আসে, তাহলে সেই কেন্দ্রের কর্মীরা প্রাণীটির ঘাড়ের চিপ স্ক্যান করে তার সব তথ্য বের করে ফেলতে পারবেন। সেখান থেকে পাওয়া ফোন নম্বরে কল করে জানিয়ে দেওয়া হবে, বিড়াল বা কুকুরটি তাঁদের আশ্রয়ে আছে। মাইক্রোচিপিংয়ের সনদটাও নিয়ে রাখতে হবে।
আরেকটা জরুরি সনদ প্রাণী চিকিৎসকের ছাড়পত্র। যেখানে উল্লেখ থাকবে পোষা প্রাণীটির কোনো রোগ বা সমস্যা নেই, শ্বাসকষ্ট নেই। সব টিকা দেওয়া আছে, প্রাণীটিকে বাইরে নিয়ে যেতে কোনো সমস্যা নেই। এরপর পোষা প্রাণীর পাসপোর্ট। কেয়ার অ্যান্ড কিওর ভেটেরিনারি ক্লিনিক থেকে এই পাসপোর্ট করতে হয়। পাসপোর্টে পোষা প্রাণীর ছবি, নাম, ঠিকানা, ওজন, যে টিকাগুলো দেওয়া হয়েছে, সব তথ্য থাকে। এ ছাড়া লাগে স্বাস্থ্য এবং কোয়ারেন্টিন সনদ। ‘পাখি’র জন্য নির্দিষ্ট মাপের খাঁচা আর ব্যাকপ্যাকএ কিনে রাখে প্রেরণা।
আস্তে আস্তে প্রেরণা-প্রতীক্ষাদের নিউইয়র্ক যাওয়ার সময় হয়ে যায়। নিউইয়র্কের পথে উড়াল দেওয়ার দিন পাখির জন্য তিন–ভাইবোনের সেকি কান্না। নিউইয়র্ক পৌঁছেই ভিডিও কল দিয়ে পাখিকে দেখতে চায় তারা। জানতে চায়, পাখিকে নেওয়ার কী করলেন। আবার ওদের আশ্বস্ত করেন মা, সব ব্যবস্থা হচ্ছে।
প্রতিদিনই দুই বেলা করে তিন ভাইবোন বাংলাদেশে ভিডিও কল করে। পাখির সঙ্গে কথা বলে। বলে, পাখিমণি, আর মাত্র কয়েকটা দিন।
ছাড়পত্র–বিভ্রাট
দেখতে দেখতে প্রেরণার মায়েরও নিউইয়র্ক যাওয়ার সময় হয়ে আসে। প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। সবার আগে পাখির ব্যবস্থা। কেয়ার অ্যান্ড কিওর ভেটেরিনারি ক্লিনিক থেকে পাখিকে ভ্যাকসিন দেওয়ান। নেন স্বাস্থ্যসনদ। পাসপোর্টের ব্যবস্থা অবশ্য প্রেরণাই করে গিয়েছিল। হোমবাউন্ডের মাধ্যমে এনওসিসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র প্রেরণার মা করে ফেলেন।
টার্কিশ এয়ারলাইনস পোষা প্রাণী বহন করে, সেখানেই নিজের আর পাখির টিকিট বুকিং দেন। তারপর নির্ধারিত দিনে পাখিকে নিয়ে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে হাজির হন ওদের মা। বোর্ডিং করার সময় বাদ সাধে টার্কিশ এয়ারলাইনস। তারা জানায়, আর সব কাগজপত্র থাকলেও পাখির এয়ারলাইনস ছাড়পত্র নেই। ছাড়পত্র ছাড়া বিমানে উঠতে পারবে না পাখি। প্রেরণার মা যত বলেন এয়ারলাইনসের যাবতীয় চাওয়া সম্পন্ন করেই তিনি এসেছেন। কিন্তু টার্কিশ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ অনড়। তারা সাফ জানিয়ে দেয়, অসম্ভব।
পাখিকে রেখেই উড়াল দেন প্রেরণার মা।
তিন মাস পর দেশে আসে প্রেরণা, প্রতীক্ষা ও প্রচ্ছদ। পাখিকে নিয়েই এবার তারা নিউইয়র্ক ফিরবে। তাই পরদিন থেকেই লেগে পড়ে প্রেরণা, নতুন করে পাখির কাগজপত্র করে। পাসপোর্ট, স্বাস্থ্যসনদ, এনওসি। টার্কিশ এয়ারলাইনসেই পাখিসহ তিন ভাইবোনের টিকিট বুক করেন বাবা।
ফিরে যাওয়ার দুই দিন আগেই কবে, কোন ফ্লাইটে পাখি যাচ্ছে, বিস্তারিত তথ্যসহ এয়ারলাইনসে ই-মেইল করে তার জন্য একটা ছাড়পত্র চায় প্রেরণা। কিন্তু এয়ারলাইনস থেকে ফিরতি মেইল আর আসে না। যাওয়ার দিন ফিরতি মেইল পায় প্রেরণা। এয়ারলাইনস ছাড়পত্র দিয়েছে, একই বিমানের হোল্ডে যেতে পারবে পাখি। ততক্ষণে পাখিকে রেখে তারা যাবে না, এমন একটা সিদ্ধান্তও প্রায় নিয়ে ফেলেছিল তিন ভাইবোন।
বাড়িতে হইচই পড়ে যায়। সন্ধ্যায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশে যাত্রা করে তিন ভাইবোন। এ যাত্রায় তাদের সঙ্গে মা-বাবা কেউ যাচ্ছেন না। এয়ারলাইনস ছাড়পত্রসহ সব নথি ঠিক থাকায় বোর্ডিং করতে কোনো অসুবিধা হয় না। পাখির টিকিটের মূল্য ডলারে পরিশোধ করার পর পাখিকে একই বিমানের হোল্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পোষা প্রাণী থাকলে বিমানের হোল্ডিংয়েও একই তাপমাত্রা রাখা হয়, যেটা যাত্রীরাও পান। কোনো প্রাণীর যাতে শ্বাসকষ্ট না হয়।
প্রায় ২২ ঘণ্টার জন্য প্রেরণাদের থেকে আলাদা হয়ে যায় পাখি। নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে আবার একত্র হয় তারা। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে উড়ে যায় পাখি।
মার্কিনমুলুকে এখন ভালোই আছে পাখি। খালি একটু একা হয়ে গেছে ও।