কৃষি গুচ্ছে প্রথম জাইমুন

‘ভর্তি পরীক্ষার সেই সময় বাড়ি গেলে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে চলতাম’

২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো গত ২৯ অক্টোবর। প্রথম হয়েছেন ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো জাইমুন ইসলাম। ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯৬.৫০ পেয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীর রহমান

প্রথম আলো:

পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ২০ জুলাই। সেই পরীক্ষা হলো ২৫ অক্টোবর। এরপর ফল হাতে পেলেন। এত দীর্ঘ অপেক্ষার পর সাফল্য পেতে কেমন লাগে?

ভালো প্রস্তুতি ছিল। ভালো করব—এটা জানতাম। পরীক্ষা দেওয়ার পর বুঝতে পারি, ফলটাও ভালো হবে। তাই বলে প্রথম হয়ে যাব বুঝতে পারিনি। প্রথম হয়ে যতটা না আনন্দিত হয়েছি, তার চেয়ে বেশি ভালো লেগেছে পরিবারের সদস্যদের খুশি দেখে।

প্রথম আলো:

প্রথম হওয়াটা তো নিশ্চয় সহজ না। কীভাবে সম্ভব হলো?

প্রথম হওয়ার ক্ষেত্রে একক কৃতিত্ব দিতে হলে আমার দাদাকে দিতে হবে। তিনি ময়মনসিংহের ফুলপুরের একজন ব্যবসায়ী। ২০১৮ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর আমার ও আমার পরিবারের খরচ থেকে শুরু করে সব দেখভাল তিনিই করেন। স্কুল-কলেজে ভালো ছাত্র ছিলাম। সবার প্রত্যাশাও তাই বেশি ছিল। উচ্চমাধ্যমিকে দেখা গেল কাঙ্ক্ষিত ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ আসেনি। সবার মন খারাপ দেখে একটু হতাশই হয়েছিলাম। যার সরাসরি প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ওপরও পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাইনি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পেছনের দিকে ছিলাম। জিএসটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় মেধাক্রম এল ২৭০০। দাদা তখনো ভালো-মন্দ কিছু বলেননি। এদিকে আমি অপরাধবোধে ভুগছিলাম—‘তিনি আমাদের জন্য এত কিছু করছেন অথচ আমি একটা ন্যূনতম ভালো ফল করে তাঁকে দেখাতে পারছি না।’ নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিল খুব। সেটাই ছিল আমার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণা—আমাকে ভালো কিছু করতেই হতো।

প্রথম আলো:

কোনো নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল?

মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজিতে ‘এ মাইনাস’ আসায়, সেই পথে এগোইনি। ভেবেছিলাম পরীক্ষাই দিতে পারব না। পরে প্রকৌশল গুচ্ছতে পরীক্ষা দিতে পারলেও ভালো কিছু হয়নি।

প্রথম আলো:

প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছিলেন?

কৃষি গুচ্ছের পরীক্ষার আগে নিয়মিত পড়াশোনা করছিলাম। যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হলো, তখন পড়াশোনায় একটা ছেদ পড়েছিল। এরপর আবার শুরু করলাম। ব্যাপকভাবে না হলেও নিয়মিত পড়তাম। একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিলাম। যেখানে তারিখের নিচে, পরীক্ষার কত দিন বাকি লেখা ছিল। ক্যালেন্ডার দেখে ৩৪ দিন আগে থেকে কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করি। এটাই আমার মূল প্রস্তুতি ছিল। মেসে থাকতাম। ওই সময়টা এমন ছিল—মেসে বিরিয়ানি রান্না হলেও খেতাম না। কারণ, অতিরিক্ত তেলজাতীয় খাবার খেয়ে যদি অসুস্থ হয়ে যাই, একটা দিন নষ্ট।

প্রথম আলো:

প্রস্তুতির সময়ে কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়েছে, যেটা সব সময় মনে থাকবে?

কয়েকটা ভর্তি পরীক্ষায় যখন খারাপ করলাম, এলাকার সবাই বলা শুরু করল, ‘ছেলে পড়ালেখা করেনি, কী করছে, কে জানে!’ আমার আম্মু ফোন করে বলল, ‘বাবা, ওরা বলছে তুমি নাকি পড়ালেখা করনি।’ অথচ আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিতে সুযোগ পেয়েছি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা পেয়েছি। যদিও এই ফলগুলো প্রত্যাশার চেয়ে কম। তখন চারপাশ থেকে চাপ আসছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতি মাসেই আমাকে বাড়িতে যেতে হতো বাজার করার জন্য। ভর্তি পরীক্ষার সেই সময় বাড়িতে গেলে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে চলতাম। কার সামনে পড়ি, কে কী বলে বসে!

জাইমুন ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত
প্রথম আলো:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বা শাবিপ্রবিতে ভর্তি হলেন না কেন?

ফলিত গণিত বা পদার্থবিজ্ঞান ঠিক টানছিল না। তাই কৃষি গুচ্ছতে পরীক্ষা দেওয়া। এখন সুযোগ যেহেতু পেয়েছি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েই কৃষি নিয়ে পড়ব। ইচ্ছে আছে, কৃষি গবেষণায় অবদান রাখার।

প্রথম আলো:

ছোটরা যারা সামনে ভর্তি পরীক্ষা দেবে, তাদের প্রতি আপনার বার্তা কী থাকবে?

ভালো করার কোনো শর্টকাট উপায় নেই। অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। মন থেকে চাইতে হবে। যারা হতাশ হয়ে পড়ে, তাদের উদ্দেশে বলব—হতাশা কখনো ভালো কিছু আনবে না। কখনোই না। হতাশা থেকে সব সময় দূরে থাকতে হবে। আমারও মাঝেমধ্যে পড়তে বসতে ভালো লাগত না। পড়াশোনা করতে মন চাইত না। এটা মূলত নির্ভর করে অভ্যাসের ওপর। কিছুদিন যদি নিজের সঙ্গে একটু যুদ্ধ করে পড়ার টেবিলে বসা যায়, তখন পড়াশোনাও একটা অভ্যাসের মধ্যে এসে যায়। সুতরাং যারা ভালো করতে চাইছে, তাদেরকে প্রথম প্রথম নিজের সঙ্গে একটু যুদ্ধ করতে হবে। তাহলে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে।