এত রাতে রুমে আলো জ্বলতে দেখে অবাক হয়ে যাই। সন্তর্পণে দরজার কাছে এসে দাঁড়াই। বাবাকে একা একা কথা বলতে দেখে রুমে ঢুকব কি না, ভাবতে ভাবতে ঢুকেই পড়ি। আমাকে দেখে কিছুটা শান্ত হয়ে বসেন, ধীরে বলতে থাকেন, এত কষ্টের সার্টিফিকেটগুলোর আজকের পর আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না। মূল্যহীন হয়ে যাবে।
বাবার হাতের ওপর হাত রেখে শান্তভাবে বলি, ‘একটা সময় মানুষ নিজেই সার্টিফিকেট হয়ে যায়, তখন নিজেই সে একটা ব্র্যান্ড। তখন আর কাগজের সার্টিফিকেট দরকার পড়ে না বাবা। আর আমি তো আছি তোমার নতুন সার্টিফিকেট।’
আমার কথা শুনে বাবার মন ভরে যায়।
কালই বাবার শেষ অফিস। হয়তো এই ভেবে তাঁর শরীর-মন অস্থির। রাতে খাবার সময় বলছিলেন, লম্বা সময় নিয়ে ঘুমাতে যাবেন। কিন্তু অস্থিরতায় হয়তো ঘুম আসছিল না, শোবার ঘরেই পায়চারি করছিলেন। কী মনে হওয়ায় সার্টিফিকেট ভরা ফাইল খুলে বসে ছিলেন, আর তখনই ছাত্রজীবনের সব অর্জন, ব্যর্থতা, সুখ, দুঃখ হুড়মুড় করে তাঁর সামনে আসতে থাকল। মা-বাবা, শিক্ষক, নীল মাঝি এবং যারা তাঁকে বন্ধু মনে করেছে এবং যারা তাঁকে বন্ধু মনে করেনি, বাবার সব স্মৃতিই যেন আজ ভীষণ জীবন্ত।
বড়দের আদর স্নেহ ছাড়া, বন্ধুদের ভালোবাসা ছাড়া গতি হারায় জীবন। বাবা মানে একজন আনিসুর রহমান বুঝে না-বুঝে ঋণী হয়ে আছেন অনেকের কাছে। বেশির ভাগ ঋণ তিনি শোধ করতে ভুলে গেছেন কিংবা অন্য কোনো কারণে শোধ করা হয়ে ওঠেনি। খুব মনে পড়ছে দুধকুমার নদের সেই নীল মাঝিকে, যাঁকে তিনি ডাকতেন নীল চাচা। যিনি কত শতবার নদী পার করে দিয়েছেন কিন্তু ঋণ শোধ করার সুযোগ না দিয়েই চলে গেছেন না-ফেরার জগতে। মা-বাবা, শিক্ষক, বন্ধুদের অনেকের জন্যই আজকে খুব অস্থির লাগছে।
বাবার মন আরও ভালো করতে এবার বলি, আমাদের দুই কাপ চা লাগবে, তাই না বাবা?
বলক ওঠা পানিতে কিছুটা চা-পাতা দিতেই পানি আর চা-পাতার যে তোলপাড়, এ যেন জীবনেরই তোলপাড়। আমি চায়ের কাপ হাতে বাবার রুমে এসে দেখি, বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন।
বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খেয়াল করি নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়েও রাস্তার ল্যাম্পপোস্টটি আলো ছড়াচ্ছে। কিছু মানুষও তেমনি বাবার মতো আলো ছড়াতে জানে। রাতের অন্ধকার ম্লান করে দিয়ে আলোকিত হচ্ছে চারপাশ। আলোর সুন্দর দিক অন্ধকার কাটিয়ে সব স্পষ্ট করে তোলে। বাগানের গাছপালার পাতা, তাদের বাকল, দেখতে দেখতেই সব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পাখিরা তাদের ভাষায় হয়তো সারা দিনের রুটিন ঠিক করে নিচ্ছে, আমাদের কাছে যে শব্দ কিচিরমিচির মনে হয়। কর্মজীবন এমনই।
আপনিও লিখুন
জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে কত সুখস্মৃতি, রোমাঞ্চজাগানিয়া ঘটনা, আছে উত্থান-পতন, পাওয়া না-পাওয়ার খতিয়ান। আপনার জীবনের এমন ঘটনার কথাই লিখুন ‘জীবন যেমন’ বিভাগে।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা
প্র ছুটির দিনে, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০-২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫
ই-মেইল: [email protected]
ফেসবুক পেজ: fb.com/ChutirDine