গাদিলাপাতা কী? আর এই পাতা কীভাবে নারীদের জন্য আশির্বাদ হয়ে উঠল?
বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ গাদিলা। এই গাছের পাতা কিছুটা সরু ও লম্বা আকারের, বহু শিরায় বিন্যস্ত। গাদিলাগাছের চেয়ে গাদিলাপতা বেশি পরিচিত। এই পাতা ব্যবহৃত হয় হস্তশিল্পের পণ্য তৈরিতে। গাদিলাগাছের পাতা সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করে তা হস্তশিল্প পণ্য তৈরিতে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। এই গাদিলাপাতা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজের প্রতিটি পর্যায়ে জড়িত থাকেন গ্রামের নারীরা।
গাজীপুরের শ্রীপুরের বিভিন্ন গজারি বনে দেখা মেলে এসব গাদিলাগাছ। ভাওয়ালের বনাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী উদ্ভিদের মধ্যে গাদিলাগাছ একটি। আর এই অঞ্চলের বনের আশপাশে বসবাসকারী শত শত নারী গাদিলাপাতা সংগ্রহের কাজ করেন। এরপর সেটা প্রক্রিয়াজাত করে পাইকারের হাত পর্যন্ত পৌঁছে দেন তাঁরা। পাতা বিক্রির টাকায় ওই নারীরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের সংসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। স্থানীয় লোকজনের তথ্যমতে, উপজেলার বেড়াবাড়ি, বাঁশ কোপা, হালুকাইদ, চাউবন, বরমী, নয়াপাড়া, দড়ি খুঁজেখানিসহ বিভিন্ন গ্রামের গজারি বনে পাওয়া যায় এসব গাদিলাপাতা।
সম্প্রতি এক দুপুরে শ্রীপুরের গোসিংগা ইউনিয়নের বেড়াবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গজারি বনের ভেতর নারীরা গাদিলাপাতা সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বনের অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত স্থানে লম্বা দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ গাদিলাপাতা। ওই গ্রামের বেশির ভাগ বাড়ির উঠান ও আশপাশেও দেখা মেলে গাদিলাপাতা শুকানোর এই দৃশ্য। বাড়ির আঙিনায় বসে সংগৃহীত কাঁচা পাতা দড়িতে মালার মতো গাঁথার কাজেও ব্যস্ত দেখা যায় বেশ কয়েকজন গৃহিণীকে। অনেকেই আবার বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে শুকনো পাতা বাজারজাতকরণের জন্য বস্তাবন্দী করছেন।
বেড়াবাড়ি গ্রামের বন থেকে গাদিলাপাতা সংগ্রহের সময় কথা হয় গৃহিণী আরতি রানির সঙ্গে। তিনি জানান, এই গ্রামে অনেক বাড়িতেই গৃহিণীরা গাদিলাপাতা সংগ্রহ করেন। গ্রামের অন্তত ১৫ থেকে ২০টি পরিবারের নারীরা গাদিলাপাতা সংগ্রহে জড়িত। এ ছাড়া গোসিংগা ইউনিয়ন, বরমী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের শতাধিক নারী গাদিলাপাতা সংগ্রহ করে সংসার চালান।
আরতি রানি বলেন, ‘একেক দিন বন থেকে ১০-১৫ কেজির মতো গাদিলাপাতা সংগ্রহ করা যায়। এগুলো শুকিয়ে প্রতি পাঁচ কেজি পাতা থেকে বিক্রির উপযোগী এক কেজি গাদিলাপাতা পাওয়া যায়। পাতা সংগ্রহের নির্দিষ্ট সময় আছে। প্রতিবছর বৈশাখ মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত বন থেকে গাদিলাপাতা সংগ্রহের কাজ চলে। একবার পাতা তুলে আনলে ওই গাছ থেকে পরের মাসেই আবার পাতা পাওয়া যায় না। কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়।’
বেড়াবাড়ি গ্রামের নবম শ্রেণির ছাত্রী মনীষা রানি। বাড়ির আঙিনায় বসে গাদিলাপাতা শুকানোর কাজ করছিল। মনীষা বলে, ‘গাছ থেকে পাতা আনার পর সেগুলো সুতায় মালার মতো গাঁথা হয়। এরপর পাতা সেদ্ধ করে সেগুলো কড়া রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। কড়া রোদ হলে এক দিন শুকাতেই চলে। রোদের তাপ কম হলে দুই দিন পর্যন্ত শুকানোর দরকার পড়ে। এরপর শুকনো পাতা সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কুয়াশায় রাখা হয়। কুয়াশায় রাখার এই প্রক্রিয়াকে স্থানীয় ভাষায় “উষানো” বলে। পরে পাতাগুলো বস্তাবন্দী করে স্থানীয় পাইকারের কাছে বিক্রি করা হয়।’
মনীষা নিজে পড়াশোনার পাশাপাশি গাদিলাপাতা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণে তার মাকে সহযোগিতা করে। গাদিলাপাতা বিক্রি ও গরু লালনপালন করে তাঁদের সংসার চলে।
গোসিংগা গ্রামের বাসিন্দা মোস. আম্বিয়া খাতুন ও তাঁর আশপাশের আরও চার-পাঁচজন নারী প্রায় ১০ বছর ধরে গাদিলাপাতা সংগ্রহের কাজ করেন। এসব পাতা শুকানোর পর স্থানীয় পাইকারের কাছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। পাতার আকার অনুযায়ী দাম কমবেশি হয়। এ ছাড়া ছেঁড়াফাটা পাতার দাম আরও কম হয় বলে জানা যায়।
বরমী ইউনিয়নের নাসিমা খাতুন স্বামীর আয়ের পাশাপাশি পাতা বিক্রি করে প্রতি মাসে ছয় থেকে আট হাজার টাকা আয় করেন। বিভিন্ন বন থেকে গাদিলাপাতা সংগ্রহ করে নিজের উঠানে সেগুলো শুকিয়ে পৌঁছে দেন গোসিংগা ইউনিয়নের বেড়াবাড়ি গ্রামের পাইকার আবুল হাশেমের কাছে। শ্রীপুরে গাদিলাপাতা পাইকারিভাবে ক্রয় করেন, এমন চার থেকে পাঁচজন পাইকার আছেন।
অনেক কৃষি পরিবারের নারীরা এই গাদিলাপাতার আয় দিয়ে সংসার খরচে কিছুটা হলেও আর্থিক অবদান রাখেন। অসচ্ছল পরিবারে এই আয় বিশেষ হয়ে দেখা দেয়। চাউবন গ্রামের বাসিন্দা জরিনা বেগম বলেন, ‘২০ কেজি শুকনো পাতা নিয়ে এসেছি বিক্রি করতে। ১ হাজার টাকার মতো পাব। পারিবারিক কৃষি আয়ের পাশাপাশি এটি সংসারের অতিরিক্ত আয়।’ নারী হিসেবে ঘরের অন্যান্য কাজ করার পাশাপাশি পাতা তুলে খুব সহজেই কিছু টাকা আয় করতে পারেন বলে নিজেরও ভালো লাগে বলে জানান।
বেড়াবাড়ি গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা মো. জৈনউদ্দিন বলেন, তাঁদের গ্রামে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে গাদিলাপাতা সংগ্রহের কাজ চলে। আগে এসব পাতা দিয়ে লোকজন বিড়ি বানাত। তবে এখন এই পাতার বহুবিধ ব্যবহার আছে। বিশেষ করে কৃষকের মাথাল তৈরিতে এই পাতার ব্যবহার হচ্ছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি। তবে এই পাতা এখন ঝুড়িসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প পণ্য তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি রিসোর্টের অন্দরসজ্জাতেও গাদিলাপাতার ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই চাহিদাও বাড়ছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাদিলাপাতা শুকানোর পর সেটি কুয়াশায় ভেজানো হলে এই পাতার স্থায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। এটি সহজে ছেঁড়ে না, এমনকি ভাঙেও না। ফলে পাতাটি স্থায়িত্ব বাড়ে। গ্রামের নারীরা এই পাতা সংগ্রহ করে পারিবারিক আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। আগে শ্রীপুরের গজারি বনের ভেতর প্রচুর গাদিলাগাছ ছিল। কিন্তু এখন গাছগুলো একদমই কমে গেছে। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ের পাইকারেরা গাজীপুর সদরের মির্জাপুর বাজারে এগুলো বিক্রি করেন। সেখান থেকে বেশির ভাগ পাতা চট্টগ্রামের বড় পাইকারদের কাছে চলে যায়। সেখান থেকে পরে প্রয়োজনমতো কিনে নেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
পাতা সংগ্রহ করে গ্রামের সাধারণ নারীরা যে টাকা আয় করেন, তা দিয়ে পরিবারের ছোটখাটো চাহিদা মেটে। সন্তানদের নিয়মিত পড়াশোনার খরচের ব্যয় মেটাতে কেউ কেউ এই টাকা খরচ করেন। কেউ আবার সংসারের প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করেন পাতা বিক্রির টাকা। স্থানীয় এই বাগানগুলো নারীদের কিছুটা হলেও আর্থিকভাবে শক্তিশালী হতে ভূমিকা রাখছে।