সাবিনার পণ্য মাসে বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকায়, সহায়তা করছেন ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের

সাইকেল চালিয়ে সাবিনা ইয়াসমিন কাপড় বিক্রি করতে চলে যেতেন বিভিন্ন ব্যাংকে, পরিচিত ব্যক্তিদের অফিসে
ছবি : সংগৃহীত

মাত্র ১০ হাজার টাকা নিয়ে স্বল্প পরিসরে ব্যবসা শুরু করেছিলেন উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁর ডাকনাম মাধবী। সাবিনার গড়ে তোলা সেই ‘মাধবী মার্ট’–এ এখন প্রতি মাসে বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার পণ্য। শুরুতে কেবল পরিচিতজনদের কাছেই পণ্য বিক্রি করতেন সাবিনা, এখন তাঁর পণ্য যায় বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে।

কেবল উদ্যোক্তা হিসেবেই নয়, সাবিনা পরিচিতি পেয়েছেন স্তন ও জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির ব্যতিক্রম কর্মকাণ্ডের জন্যও। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছেন নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গল্প।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার রানাহিজল গ্রামে বেড়ে উঠেছেন সাবিনা, প্রাথমিকের পড়াশোনাও সেখানে। মোহনগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর উচ্চমাধ্যমিক পড়তে চলে আসেন ময়মনসিংহে। এরপর ঢাকার একটি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। স্নাতক পড়তে পড়তেই ব্যবসায় হাতেখড়ি। মোহাম্মদপুরের আরেক নারী উদ্যোক্তা শাহিনা আক্তারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকার পণ্য নিয়ে বিক্রি করতে শুরু করেন।

মাত্র ১০ হাজার টাকা নিয়ে স্বল্প পরিসরে ব্যবসা শুরু করেছিলেন উদ্যোক্তা সাবিনা ইয়াসমিন
ছবি : সংগৃহীত

প্রথমে কিছুদিন পরিচিতদের কাছে বিক্রি করতেন। এরপর নিজের কলেজের সামনে ফুটপাতে বসেও বিক্রির চেষ্টা করেছেন। সাবিনা সাইকেল চালনায় পটু, সেই সাইকেলেই কাপড় নিয়ে চলে যেতেন বিভিন্ন ব্যাংকে, পরিচিতদের অফিসে। এভাবে ধীরে ধীরে তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ২০১৮ সালে ফার্মগেটের ক্যাপিটাল সুপার মার্কেটে একটি দোকান নেন। দুই বছর চালানোর পর কোভিডের কারণে ২০২০ সালে সেই দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। তখন চলে যান জামালপুরের সরিষাবাড়ী। হঠাৎ করে কেন জামালপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে আমি কাজ করতাম নকশিকাঁথা নিয়ে। ভৌগলিকভাবে নকশিকাঁথার কাজ ভালো হয় জামালপুরে। সে জন্যই সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

সরিষাবাড়ীতেই হাতের কাজের পণ্যের ব্যবসাটা আরও ভালো করে শিখেছেন সাবিনা। তাঁর সঙ্গে এখন জামালপুরের এক হাজার নারী সরাসরি কাজ করেন। পাশাপাশি রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর ও কুষ্টিয়ার স্থানীয় নারী সূচিশিল্পীরাও কাজ করছেন।

‘মাধবী মার্ট’–এর অবস্থান উত্তরা উত্তর মেট্রো রেলস্টেশনের পাশেই
ছবি : সংগৃহীত

কেন হাতের কাজের পণ্যে আগ্রহ

দেশি পণ্যে সব সময়ই আগ্রহ ছিল সাবিনার। তিনি দেখেছেন, ভালো মানের পণ্য দিতে পারলে ক্রেতারা তা লুফে নেন।

সাবিনা বলছিলেন, ‘যখন জামালপুরে গেলাম, দেখলাম নারীরা এই হাতের কাজের আয় দিয়ে সংসার চালান, চাল-ডাল কেনেন, সন্তানের পড়ার খরচ দেন। হয়তো তাঁদের স্বামীরা দিনমজুর বা রিকশাচালক। স্ত্রী ঘরের কাজের ফাঁকে কাঁথা সেলাই করে বাড়তি আয় করছেন। তখন মনে হলো, আমি যদি মানুষের জন্য কিছু করতে চাই, তাহলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। এই নারীদের যদি আমি সারা বছর কাজ দিতে পারি, তাহলে তাঁরা সারা বছর আয় করতে পারবেন।’

যাঁদের সঙ্গে কাজ, যা নিয়ে কাজ

‘মাধবী মার্ট’–এর অবস্থান উত্তরা উত্তর মেট্রো রেলস্টেশনের পাশেই। সেখানে মিলবে নানা ধরনের দেশি পণ্য। নকশিকাঁথাই মূল পণ্য। এ ছাড়া পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জের জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁত, সিলেটের মণিপুরি, কুমিল্লার খাদি, রাজশাহী সিল্কে কাঁথা স্টিচ, কুমিল্লার বাটিক, ন্যাচারাল ডাইসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি শাড়ি। একই ছাদের নিচে আছে হোগলা পাতা, কচুরিপানা, সুপারির খোলের তৈরি পণ্য।

সাবিনা বলছিলেন, ‘আমাদের প্রথম চেষ্টা থাকে কারিগর ও তাঁতিরা যেন লাভবান হন সেটা দেখা। না হলে তো তাঁরা পেশাবিমুখ হয়ে পড়বেন। আমরা সুলভ দামে পণ্য বিক্রি করি, যেন ক্রেতারা কিনতে পারেন। তাঁদের যেন দেশি পণ্যের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।’

সাবিনা কেবল একজন সফল উদ্যোক্তাই নন, যুক্ত আছেন নানা সামাজিক কাজেও
ছবি : সংগৃহীত

সাইকেলের ডানায় ক্যানসার জয়ের স্বপ্ন

সাবিনা কেবল একজন সফল উদ্যোক্তাই নন। করেন নানা সামাজিক কাজও। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও পোশাক কারখানায় গিয়ে নারীদের ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন করেন। কোথায় চিকিৎসা করাতে হবে, সে তথ্যও দেন।

সাবিনা বলেন, ‘সাইকেল চালিয়ে ৫১টি জেলা ঘুরেছি। অনেক নারীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। এ পর্যন্ত সাড়ে চার শর বেশি রোগীকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে এসেছি।’

কীভাবে এই কর্মযজ্ঞ সামাল দেন, তা জানতে চাইলে সাবিনা বলেন, ‘যখন কোনো নারীর স্তন বা জরায়ুমুখ ক্যানসারের কোনো লক্ষণ দেখি বা কেউ যখন ফোন করে অসুবিধার কথা জানান, তখন তাঁকে কাছের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসকের যদি সন্দেহ হয়, তখন আলট্রাসনোগ্রাফি, কোর বায়োপসি এবং রক্ত পরীক্ষার মতো কিছু পরীক্ষা করানো হয়। কোনো পরীক্ষায় প্রমাণ মিললে তাঁকে ঢাকার মহাখালী ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাই। সেখানে পরবর্তী চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। কারও হয়তো অস্ত্রোপচার লাগে, কারও লাগে কেমোথেরাপি। কারও আবার দুটোই লাগে।’

এ প্রসঙ্গেই জানা গেল, ‘মাধবী মার্ট’–এর লভ্যাংশের একটি অংশ ব্যয় হয় ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের চিকিৎসায়।

সাবিনা যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যান, তখন সেখানে নারীদের কাছে মুঠোফোন নম্বর দিয়ে আসেন। সেখানেই ফোন করে যোগাযোগ করেন নারীরা। আর এ কাজে সহায়তার জন্য সাবিনার এবটি দক্ষ দল আছে। যাঁরা নারীদের ফোন ধরেন এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন, পরামর্শ দেন।

নকশি কাঁথা মাধবী মার্টের মূল পণ্য
ছবি : সংগৃহীত

সম্মাননায় উৎসাহ

ব্যতিক্রম এই কাজের জন্য ২০২১ সালে মাধবী পেয়েছেন দ্য ডেইলি স্টার-আইপিডিসি আনসাং উইমেন ন্যাশন বিল্ডার্স অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, আহসানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল ও ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষ থেকেও পেয়েছেন পুরস্কার।

মাধবীর স্বপ্ন

ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনা যেমন ছড়িয়ে দিতে চান, তেমনি মাধবী মার্টকেও সারা বিশ্বে নিয়ে যেতে চান মাধবী। মাধবী বললেন, ‘আমি চাই দেশের সব জেলা-উপজেলায় থাকবে মাধবী মার্টের শাখা। কেবল ৬১ দেশে নয়, বিশ্বের সব দেশে যাবে মাধবী মার্টের পণ্য।’

আন্তর্জাতিক বাজারের কথা মাথায় রেখে পণ্য তৈরির জন্য এরই মধ্যে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানালেন মাধবী। যেখানে তাঁরা কাজ করতে চান নিত্যব্যবহার্য পোশাক নিয়ে।

নারীদের ক্যানসার চিকিৎসার জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির কাজ করছেন বলে জানালেন মাধবী। তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন নারীদের জন্য একটি বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি করা। যেখানে নারীরা বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে চিকিৎসা পাবেন।’