ছেলের দৌড়টা দেখলে আজও চোখ ভিজে যায়

ছেলে আসওয়াদের সঙ্গে মা ফারজানা জাহান
ছবি: সংগৃহীত

সন্তানকে ভালো স্কুলে ভর্তি করানো যে কতটা চ্যালেঞ্জের, তা তো আমরা জানি। ঢাকার এ রকম একটা নামকরা স্কুলে আমার ছেলে আসওয়াদ যেদিন লটারিতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির চান্স পেল, সেদিন বাসায় ঈদের খুশি অনুভব করছিল সবাই। এরপর ক্লাস শুরু হলো। প্রথম দিন ছেলেকে নিয়ে স্কুলে গিয়ে দেখি নবীনবরণের আয়োজন। ছেলেটা আমার ফুল হাতে মাঠের মধ্যে কী দৌড়টাই না দিল। ভিডিওটা দেখলে আজও আমার চোখ ভিজে যায়। 

স্কুলে ভর্তির পর বাসা থেকে প্রতিদিন তাকে নিয়ে যাই, নিয়ে আসি। এভাবে একটা বছর ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন অনেক অসুস্থ হয়ে গেল আসওয়াদ। এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার করতে করতেই কেটে গেল অনেকটা দিন। এ কারণে অসুস্থতার ঠিকঠাক কারণ ও নাম খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগে গেল। তারপর জানতে পারলাম ওর ‘ট্যুরেট সিনড্রোম’ হয়েছে। এটি স্নায়ুবিকাশজনিত (নিউরো ডেভেলপমেন্টাল) একটি অসুখ।

শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনি, নড়াচড়া ও মুখের নানা রকম শব্দ আমার বাচ্চাটাকে একেক সময় একেক রকম কষ্ট ও অস্বস্তির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। জীবনের আনন্দ-খেলায় যখন তার মেতে থাকার কথা, তখন তাকে নিয়ে আমি সময় কাটাই ডাক্তারের চেম্বারে, কাউন্সেলিং করে। মাঝেমধ্যে কষ্টে কাঁদত ছেলেটা। কাঁদতাম আমরাও। চিকিৎসাধীন অবস্থায় জানতে পারি, মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যার সঙ্গে আসওয়াদের আছে এডিএইচডি ও ডিসলেক্সিয়া অর্থাৎ মনোযোগের ঘাটতি, সঙ্গে ডান হাতের দুর্বলতা। এসব জেনে খুব ভেঙে পড়লাম।

কিন্তু মায়েদের তো ভেঙে পড়লে চলে না। ওর চিকিৎসা চলতে থাকল। যখন চিকিৎসা চলছে, ঠিক সে সময় বিশ্বজুড়ে দেখা দিল কোভিড–১৯। হারিয়ে গেল দুটি বছর। নতুন বাস্তবতায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল পৃথিবী। আমরাও আসওয়াদকে আবার বাসার কাছে একটি সরকারি স্কুলে ভর্তি করলাম। আবার যেন প্রথম থেকে শুরু। 

আসওয়াদ অসম্ভব মিশুক ও বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে। কোনোভাবেই ওর পিছিয়ে থাকা আমি মেনে নিতে চাইনি। তাই ওর মনোবল বাড়াতে চিকিৎসার পাশাপাশি তার শরীর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ফুটবল ও কারাতে প্রশিক্ষণে ভর্তি করিয়েছি। মনোযোগ বাড়াতে নিয়মিত সাঁতার কাটাতে নিয়ে যাই। কিন্তু বাদ সাধে গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা। 

মুখে সব পারলেও ডান হাতের দুর্বলতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত লিখতে পারে না আসওয়াদ। বড় ক্লাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লেখাটা সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে লিখতে পারছে না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছে। ক্লাসেও লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ডিসলেক্সিয়া বা এডিএইচডি বাচ্চাদের জন্য আলাদা কোনো কারিকুলাম, আলাদা স্কুল বা পরীক্ষার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেই। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের শিশুদের জন্য আলাদা স্কুল নয় বরং আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা থাকে। বেসিক ট্রেনিং, স্বল্প সিলেবাস, অডিও ভিজ্যুয়াল পরীক্ষা অথবা মৌখিক ব্যবস্থা, অতিরিক্ত সময়সহ আরও অনেক কিছু। সুস্থ স্বাভাবিক ও অসুস্থ সবাই একসঙ্গে ক্লাস করে। একজন অভিভাবক হিসেবে সম্ভাবনাময় আসওয়াদদের জন্য একটা আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা কি পাব না? এসব ভেবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি কোর্সে ভর্তি হয়েছি। সেখানে অক্ষম ও অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সমন্বিত শিক্ষা বিষয়ে পড়ানো হবে। 

আমি একটা ‘চারা’ লাগাতে চাই। যে গাছের ফল আসওয়াদ না খেতে পারলেও অন্য প্রজন্ম খেতে পারবে। সেই সুদিনের অপেক্ষায় দিন গুনছি।