ঢাকা থেকে একটু দূরে এক চোখ জুড়ানো বাড়ি
ঢাকা থেকে একটু দূরে, নিরিবিলি পরিবেশে থাকার জন্য বাড়ি বানিয়েছেন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহ্নাজ মুন্নী এবং কবি সরকার আমিন। খোলামেলা সেই বাড়িতে আসবাবের বাহুল্য নেই, আছে সবুজের ছোঁয়া।
ফটক পেরিয়ে বাড়ির আঙিনায় ঢুকতেই নীল জলের ভূমধ্যসাগর। বাংলাদেশে ভূমধ্যসাগর! একটু ভাবলাম। মনে হলো, আরে, এমন তো হতেই পারে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় আছে—
‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি—
ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’
কবি যদি মনে করেন বাংলাদেশের একটি স্থানে তিনি রচনা করবেন ভূমধ্যসাগর, তবে তা–ই সই। যে বাড়িতে ভূমধ্যসাগর, সেই বাড়ি কবি–কথাসাহিত্যিক দম্পতি সরকার আমিন ও শাহ্নাজ মুন্নীর। বাড়ির নামফলকে লেখা আছে, ‘শাহ্নাজ মুন্নী–সরকার আমিন রচিত প্রশান্তিবাড়ী। স্থপতি বাঁধন সরকার।’
সরকার আমিন কবি। পেশাগত পরিচয় বাংলা একাডেমির পরিচালক। শাহ্নাজ মুন্নীও কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘নিউজ২৪’–এর প্রধান বার্তা সম্পাদক। সেই কবে এই দুজন মিলে রচনা করেছেন নিজেদের যূথজীবন। আর এখন রচনা করেছেন ‘প্রশান্তিবাড়ী’।
চলুন আবার ফিরে যাই ভূমধ্যসাগরে। এটি প্রশান্তিবাড়ীর সুইমিংপুল, দৈর্ঘ্যে ২২ ফুট, প্রস্থে ১৩ ফুট। এর জল নীল। আমিনকে জিজ্ঞাসা করি, ভূমধ্যসাগর নাম কেন? ‘ভূমির মধ্যে সাগর,’ উত্তর দেন। তখন বুঝে ফেলি। সরকার আমিন তো কবি। তিনি যদি তাঁদের সুইমিংপুলকে ভূমধ্যসাগর নামকরণ করেন—যে বাড়ি তাঁরা বানাননি, রচনা করেছেন—সেখানে তো সুইমিংপুল নয়, ভূমধ্যসাগরই সত্যি। সুইমিংপুলের পাশে নয়, ভেতরই একটি মহুয়াবৃক্ষ। সচরাচর এ গাছ চোখে পড়ে না। ‘আমার এক পাহাড়ি বন্ধু বান্দরবানের থানচি থেকে মহুয়াগাছের চারা দিয়েছিলেন। গাছটার বয়স ২০ বছর হলো। সুইমিংপুল বানানোর সময় গাছটা কাটিনি। পুলটার এক পাশ ছোট করেছি।’
প্রশান্তিবাড়ীর শুরুটা আজ থেকে ২৩ বছর আগে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার নয়াপুরে ১৩ কাঠা (২০ শতাংশ) জমি কিনেছিলেন মুন্নী–আমিন দম্পতি। ‘একটা টিনের ঘর তৈরি করি ২০০৫ সালে। মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসতাম, থাকতাম। এখানে আমাদের বন্ধুরাও মাঝেমধ্যে আসতেন। সেই ঘরকে আমরা ভুলে যাইনি।’
পুরোনো টিনের ঘরকে সত্যিই ভুলে যাননি মুন্নী–আমিন। ফটকের ডান দিকে ইটের দেয়ালে টিনের ঘরের আংশিক এখনো সংরক্ষিত। তাঁদের ভাষায় কটেজ। বর্ষাদিনে এই ঘরে ঢুকে টিনের চালের বৃষ্টি উপভোগ করা যায়। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘বৃষ্টিঘর’। পাশ থেকে শাহ্নাজ মুন্নী বলেন, ‘আমিন বাড়ির বিভিন্ন অংশের নামকরণ করেছে। নাম দেওয়ার ব্যাপারে তার জুড়ি নেই।’
বাড়িতে ঢুকে বাঁ দিকে সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে কৃষ্ণচূড়া। এখন পত্রহীন। কিছুদিন পরই যা হয়ে উঠবে লালে লাল। ডানে তো মহুয়ার ছায়ায় ‘ভূমধ্যসাগর’। মূল দালানে ঢোকার আগে আগে ছোট গোলাকার ইটের এক চত্বর। যেন হেলিপ্যাড। শ্বেতপাথরে নাম লেখা ‘অনু–প্রবুদ্ধ চত্বর’। আমিন বলেন, ‘আমার অকালপ্রয়াত দুই বন্ধু। অনেকবার এসেছেন এখানে। তাঁদের স্মৃতি মনে রেখেছি এভাবে।’ ড. অনু হোসেন ছিলেন প্রাবন্ধিক। আর প্রবুদ্ধ সুন্দরকর ভারতের আগরতলার কবি।
এই প্রশান্তিবাড়ীর দূরত্ব ঢাকা থেকে ৪২–৪৩ কিলোমিটার। ৩০০ ফুট সড়ক ধরে গেলে কাঞ্চন সেতু পার হয়ে সোজা ভুলতা চৌরাস্তা পেরিয়ে নয়াপুর। এখানে চিনতলা বাজারের ভেতর দিয়ে দেড় কিলোমিটার গেলেই প্রশান্তিবাড়ী। সরু পথের পাশে দু–একটা পথনির্দেশকও চোখে পড়ে। আশপাশে বসতি গড়ে উঠছে ভালোই। তাই বাড়িটির ফটক পেরোলেই প্রশান্তির একটা পরশ টের পাওয়া যায় মনে–শরীরে।
উঠান পেরিয়ে নিচতলায় ঢুকতেই বোঝা যায়, বাড়িটির নির্মাণে খোলামেলা আবহকেই প্রাধান্য দিয়েছেন স্থপতি। বাঁয়ে খাবারঘর। ঘর না বলে খাওয়ার জায়গা বলাই ভালো। সঙ্গে খোলা রান্নাঘর। রান্নাঘরের চৌকাঠ পেরোলে বাইরে একচিলতে সবজিবাগান। মুন্নী বললেন, ‘আমাদের কিচেন গার্ডেন। টুকটাক টাটকা সবজি এখান থেকে পাই।’ ধনেপাতা, লেটুসপাতা, লাউ—মৌসুমি সবজি বেড়ে ওঠে এই বাগানে।
প্রচলিত ভাষায় আমরা যেটাকে ড্রয়িংরুম বা বসার ঘর বলে জানি, প্রশান্তিবাড়ীতে তা মিলনায়তন। নিচতলা থেকে দোতলায় ওঠার যে কাঠের সিঁড়ি, তার পাশেই অ্যাম্ফিথিয়েটারের আদলে ইটের কয়েকটি ধাপ। সেখানে বসেও আড্ডা জমানো যায়। সরকার আমিন চেয়েছেন, মিলনায়তনে বসার অনুভূতি যেন পান অতিথিরা। নিচতলায় একটা ঘরও আছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে মোফাজ্জল হোসেন অতিথিকক্ষ। আমিন বললেন, ‘মুন্নীর বাবা মোফাজ্জল হোসেন। ১৯৯৩ সালে আমরা বিয়ে করি। আজিমপুরে দুই কামরার ছোট্ট বাসায় শুরু হয় আমাদের সংসার। আমার শ্বশুর তাঁর একটা ফ্ল্যাটে থাকতে বলেছিলেন। আমরা থাকিনি। তখনই ভেবেছি, আমাদের নিজেদের একটা বাড়ি হবে। থাকব গ্রামে, কাজ করব শহরে। সকালে ঢাকায় যাব। রাতে গ্রামের বাড়ি ফিরব।’ সেই বাড়ি হয়েছে। মোফাজ্জল হোসেনের স্মৃতিকে ধরে রাখা হয়েছে এই ঘরের নামকরণে।
নিচতলায় ছোট্ট একটা বাগান। বেশ আলোকিত। এর ছাদ পুরো তিনতলা পর্যন্ত। ছাদে কাঁচ লাগানো বড় গোলাকার ফোকর। সেই ফোকর গলে সূর্যালোক সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে বাগানের ঘাস আর ছোট ছোট গাছে। ইনডোর–আউটডোর যেন মিশে একাকার। সরকার আমিন জানালেন, ‘এটা লিফট বসানোর জায়গা। আমরা যখন আরও বুড়ো হব, হাঁটুর জোর কমে যাবে, সিঁড়ি বাইতে পারব না, তখন যাতে লিফট বসানো যায়, সে ব্যবস্থা রেখেছি।’
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতেই বোঝা গেল, এই তলাটায় থাকার ব্যবস্থা। তিনটি শোবার ঘর। তবে খোলামেলা, আর আলো–বাতাসেরও কমতি নেই। মুন্নী–আমিনের দুই মেয়ে যৌথ মনীষা ও যুক্ত মনন। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ঢাকায় থাকেন। সপ্তাহান্তে আর ছুটিতে মা–বাবার বাড়িতে আসেন। যৌথ আর যুক্তর জন্য দুটি ঘর। সেগুলোর নাম ‘যৌথঘর’, ‘যুক্তঘর’। আর মুন্নী–আমিনের শোবার ঘর ‘আনন্দঘর’। আসবাবের বেলায় এই দম্পতির পছন্দ যেন মিনিমালের চেয়ে কম। দুই মেয়ের ঘরে তো খাটও নেই। মোটা গদির বিছানা বিছানো সফেদ মেঝেতে। এ ছাড়া চেয়ার–টেবিল, আলমারির বাহুল্য নেই পুরো বাড়িতে।
এই প্রতিবেদন করার জন্য যখন শাহ্নাজ মুন্নীর সঙ্গে যোগাযোগ করি, তখন বলেছিলাম, ‘আপনাদের বাড়ি আর ইন্টেরিয়র নিয়ে লিখব।’ মুন্নী বলেছিলেন, ‘আমাদের তো ইন্টেরিয়রের কিছু নেই। লেখার মতো কিছু পাবেন না।’ দেখে বোঝা গেল, এই ‘নেই’–এর আসল অর্থ হলো বাহুল্য নেই। বাহুল্যবর্জিত এক বাসগৃহ। যেখানে মনে হয়, ঘরের ভিতরে বাহিরটা ঢুকে গেছে। অন্দর–বাহির আলাদা করাই কঠিন। বাহুল্য নেই বলেই শান্তি শান্তি ভাব ঘরের অভ্যন্তরে।
এবার তিনতলায় যাওয়ার পালা। সরকার আমিনের ভাষায় আড়াইতলা। অর্থাৎ এই তলার অর্ধেকটায় ছাদ আছে, বাকি অর্ধেক খোলা। গান শোনা, বই পড়া, বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ভালো ব্যবস্থাই রয়েছে। এই অংশের নাম ‘আকাশঘর’। বাকিটা খোলা। তবে টব আছে, গাছ আছে। সরকার আমিন এর নাম দিয়েছেন ‘ব্যাবিলনের শূনে৵াদ্যান’। ছাদের কিনারায় রেলিং ধরে দাঁড়ালে মনে হয় অসীম শূন্যে দাঁড়িয়ে আছি। ব্যাবিলনের শূনে৵াদ্যানে টকটকে লাল দুই গোলাপ ফুটে ছিল সেদিন। সরকার আমিন বললেন, ‘মুন্নী যাও, গোলাপের পাশে দাঁড়াও, একটা ছবি তুলি।’ মুন্নী দাঁড়ালেন, পোজ দিলেন। আমাদের আবদারে পরে দুজনই দাঁড়ালেন। দুই গোলাপসহ তোলা হলো দুজনের ছবি।
এই আড়াইতলার ওপর কোনো জলাধার দেখা গেল না। আমরা বাড়িতে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই এসেছেন বাড়িটির স্থপতি বাঁধন সরকার। আমাদের ভাবনায় ছিল বয়স্ক কেউ। কিন্তু বাঁধন সরকার তরুণ স্থপতি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক বাঁধন সরকারের সঙ্গে সরকার আমিনের পরিচয় ফেসবুকে। তারপর কথায়–কথায় তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁদের সুরে খুব একটা ফারাক নেই। তারুণ্যে ভরসা রাখেন মুন্নী–আমিন দম্পতি। বাঁধন দেখিয়ে দিলেন বাড়ির জলাধারটা কোথায়। সাধারণ বাসাবাড়িতে যে ফলস সিলিং থাকে, সে রকমই একটা জায়গায় পানির ট্যাংক। বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
আমাদের সামনেই আমিন বাঁধনকে বললেন, ‘ওয়াচ টাওয়ারটা এবার তৈরি করা যাক।’ এই আড়াইতলার ওপর একটা ওয়াচ টাওয়ারের মতো বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। সেখানে উঠে আশপাশটা যেন পুরো দেখা যায়। দুই কিলোমিটার দূরে থাকা নদীর রেখাও যেন চোখে পড়ে। বাঁধন জানালেন, ওয়াচ টাওয়ারে ওঠার সিঁড়িটা হবে চক্রাকার (স্পাইরাল)। যাতে জায়গা কম লাগে। মূল বাড়িটা কিন্তু কম জায়গাতেই করা হয়েছে। প্রতিটি তলার আয়তন ১ হাজার ৬০০ বর্গফুট। কিন্তু নির্মাণশৈলীর গুণে বাড়িতে ঢুকে মনে হয়, আসলে এর চেয়ে বড় আয়তন বাড়িটির।
বাড়ির নকশা করার সময় কোন ধারণা মাথায় ছিল? বাঁধন বলেন, ‘এখানে যে টিনের ঘর ছিল, সেটি বৃষ্টিঘর। তাই আমরা চেয়েছি এবার রৌদ্রঘর বানাতে।’ সেটা যে সফলভাবে হয়েছে, তা প্রশান্তিবাড়ী ঘুরে এলেই বোঝা যায়। উত্তরাধুনিক স্থাপত্য ধারায় এই বাড়ি নির্মাণ করতে চেয়েছেন বাঁধন সরকার। ‘চলতি ধারার বাইরে এসে বাড়ির নকশা করার চেষ্টা করেছি। এখানে কোনো কৃত্রিম উপকরণ ব্যবহার করিনি,’ বলেন বাঁধন। সরকার আমিন যোগ করেন, ‘বাঁধন গাছ কাটেননি; বরং সুইমিংপুল কেটেছেন। বাড়িতে আম, কাঁঠাল, মহুয়া, কৃষ্ণচূড়া, মাল্টা—বেশ কিছু গাছ আছে এখন। আরও গাছ বড় হচ্ছে।’
মূল দালানের পাশে কিছুটা জায়গা এখনো ফাঁকা, ছায়াঘেরা। যথারীতি এরও নাম রয়েছে। ‘হামিদা–সিরাজ চত্বর’—সরকার আমিনের মা ও বাবার নামে এই জায়গা।
প্রশান্তিবাড়ীর দুই মালিক এই বাড়ির দুয়ার অবারিত করেছেন সৃজনশীল মানুষদের জন্য। অতিথি আসবেন, প্রশান্তির অনুভূতি নিয়ে ফিরে যাবেন। ভবিষ্যতে এই বাড়ির মালিকানা ওয়াক্ফ ট্রাস্টের হাতে দিয়ে যেতে চান তাঁরা। দুই মেয়ে থাকবেন ট্রাস্টি। এখানে কফি শপ হবে, পাঠাগার থাকবে, শিশুরা এসে খেলা করবে—এই স্বপ্নই দেখেন কবি সরকার আমিন ও কথাসাহিত্যিক শাহ্নাজ মুন্নী।
ফিরে আসার সময় শাহ্নাজ মুন্নী বললেন, ‘আর কিছুদিন পর একদিন আসবেন। কৃষ্ণচূড়ার আগুনরঙা ফুলে ঢেকে যাবে পুরো প্রকৃতি। বৃষ্টির সময় এলে টের পাবেন অন্য রূপ।’ একদম শেষ সময় মুন্নী–আমিন জিজ্ঞেস করেন, ‘প্রশান্তি পেলেন?’ সত্যিই কয়েক ঘণ্টা কেটেছে প্রশান্তিতেই। আর তা তো হবেই, সরকার আমিনের ভাষায়, ‘এই বাড়ি ফুটানি নয়, প্রেম দ্বারা নির্মিত।’