লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির অবসান চান শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের রব উঠেছে সর্বত্র। ক্যাম্পাসে কেমন পরিবর্তন চান আপনি—আমরা জানতে চেয়েছিলাম কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছে।
ছাত্র সংসদ চালু করতে হবে
সাবরিনা ইসলাম, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম ধাপেই দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে। বিগত বছরগুলোয় দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলীয় অনুসারী তৈরির অপচেষ্টা চালিয়েছে, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, আবাসনসংকট, গেস্টরুম সংস্কৃতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ নিয়োগ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ইত্যাদি চলমান ছিল। তাই নতুন বাংলাদেশে সব ধরনের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির অবসান চান শিক্ষার্থীরা। আমরা এমন শিক্ষক চাই, যাঁদের কাছে দলীয় রাজনীতির ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানোর চেয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো ও গবেষণা বেশি গুরুত্ব পাবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক হবে সহযোগিতার।
বহু বছর ধরে ছাত্ররাজনীতির নামে নানা অপকর্ম, শোষণ, নির্যাতন চলে এসেছে। আবরার ফাহাদ, আবু বকর, রাব্বিসহ অনেক শিক্ষার্থীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বারবার যখন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের প্রস্তাব উঠেছে, তখন কেউ কেউ ছাত্রজীবন থেকেই নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ, দেশের প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতারা ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি চর্চা করে এসেছেন। সেই চর্চা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চালু করা হোক। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে। এতে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সীমা লঙ্ঘন করেছে, যার বলি হয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের মাধ্যমে একনিষ্ঠ ছাত্রনেতা তৈরি হলে যেমন শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, তেমনি দেশের ক্রান্তিলগ্নেও তাঁরা ভূমিকা রাখতে পারবেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যেকোনো অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সব সময়ই ছাত্র সংসদের সম্পৃক্ততা ছিল। তাই সুস্থ রাজনীতির চর্চা ও ছাত্র–জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্ল্যাটফর্ম ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন।
দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য নানা বৃত্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। ধর্ম বা বর্ণ নয়, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ভিত্তি হবে মেধা ও যোগ্যতা। আপাতত নির্দলীয় চিন্তা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও নিরপেক্ষ ছাত্র সংসদ চালুর প্রত্যাশা নিয়েই শিক্ষার্থীরা ফিরতে চান ক্যাম্পাসে। কারণ, সারা দেশের মানুষেরই শিক্ষার্থীদের ওপর এক ধরনের আস্থা তৈরি হয়েছে। সবাই আশায় আছেন, আমরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জনকল্যাণের স্বার্থে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেব।
গবেষণার সুযোগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন
মো. মারুফ হাসান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
ছোটবেলায় হ্যারি পটার দেখে কল্পনা করতাম, এমন একটি প্রতিষ্ঠানে যদি আমিও পড়তে পারতাম। কত সুন্দর, সাজানো-গোছানো, স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। বড় হয়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পড়ার স্বপ্নই লালন করে এসেছি। শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন অনেক সুযোগ-সুবিধাই পাওয়া যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করেই নানা রকম অসংগতি চোখে পড়ে। বন্ধুদের সঙ্গে যা নিয়ে আলোচনা করতাম। এখন সুযোগ এসেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার। আমার মনে হয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল উচ্চশিক্ষা প্রদানের কেন্দ্র নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, গবেষণা, উদ্ভাবন এবং নৈতিক মূল্যবোধ গঠনেরও কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
আর সে জন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন শিক্ষার মান নিশ্চিত করা। অরাজনৈতিক পরিবেশে আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন করা সম্ভব। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন, সম্পূর্ণ আবাসিক, প্রাণচঞ্চল ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এমনভাবে পরিচালিত করতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা শুধু পুস্তকজ্ঞান নয়, বাস্তবজ্ঞানও অর্জন করতে পারে।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ যেহেতু নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন, বর্তমানে যা খুব কম। গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করে এসব সুযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্ভাবন ও উদ্যোগগুলোকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু সৃষ্টিতে উৎসাহী হয়। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবনী কেন্দ্র এবং উদ্যোগ উন্নয়ন সেল স্থাপন করা যেতে পারে।
জ্ঞানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়া জরুরি। সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম, অন্যের প্রতি সহানুভূতি এবং মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি আত্মহত্যার প্রবণতা কমানোর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করাও জরুরি।