বাবা, তোমার মেয়ে পোল্যান্ড যাচ্ছে

অঙ্কিতা দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

গেমিংয়ের দুনিয়ায় সৃজনশীল কাজ তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘আর্টস্টেশন’ বেশ জনপ্রিয় একটি ওয়েবসাইট। এখানেই নিজের কিছু কাজের নমুনা তুলে রেখেছিলেন অঙ্কিতা দত্ত। একদিন সেখানেই চাকরির একটা বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। বিজ্ঞপ্তিটি দিয়েছে পোল্যান্ডভিত্তিক গেম কোম্পানি ইলেভেন বিট স্টুডিওজ। অঙ্কিতা তখন মোবাইল গেমের জন্য ত্রিমাত্রিক মডেল বানাতেন। কম্পিউটার গেমের সঙ্গে তখনো সেভাবে পরিচয় হয়নি। স্রেফ কৌতূহল থেকেই চাকরিতে আবেদন করেন। অঙ্কিতা বলেন, ‘ধরেই নিয়েছিলাম তারা ফিরিয়ে দেবে। তারপরও আমার কাজগুলো কম্পিউটার গেমের উপযুক্ত কি না, আমার অবস্থানটা আসলে কোথায়, তা জানতে চাইছিলাম।’

তারপর হঠাৎই একদিন অঙ্কিতার ইনবক্সে একটা ই–মেইল—ইলেভেন বিট স্টুডিওজের মানবসম্পদ বিভাগ জানাচ্ছে, তারা একটা ইন্টারভিউ নিতে চায়। অঙ্কিতার প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। ধরেই নেন, এটা একটা ভুয়া ই–মেইল। আগেও তিনি বিশ্বখ্যাত গেম কোম্পানি গেমলফট ও রকস্টার গেমসের নামে এ রকম ভুয়া মেইল পেয়েছেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

তবু একটা ক্ষীণ আশা মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল ঠিকই। ভুয়া না-ও তো হতে পারে! সে আশা থেকেই ই–মেইলের জবাব দেন তিনি। কয় দিন পরই আসে ইন্টারভিউয়ের ডাক। পরপর দুই দফা ইন্টারভিউ শেষে চাকরির ব্যাপারে নিশ্চিত করা হয়। জানানো হয়, বিট স্টুডিওজে ‘জুনিয়র থ্রিডি এনভায়রনমেন্ট আর্টিস্ট’ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অঙ্কিতা দত্ত।

অঙ্কিতার করা ডিজাইন

সে সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে অঙ্কিতা বলেন, ‘প্রথম ইন্টারভিউয়ের পর তারা আমাকে বলেছিল, দ্বিতীয় ইন্টারভিউতে বিস্তারিত জানাবে। দ্বিতীয় ইন্টারভিউতে তারা একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, “সত্যি করে বলো তো অঙ্কিতা, তুমি কি তোমার মা–বাবাকে এই ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারে জানিয়েছ?” আমার উত্তর ছিল, “না। আমি মা–বাবাকে বলিনি। কাউকেই বলিনি। কারণ, কোনো কিছু নিশ্চিত না হয়ে বলাটা ঠিকও না।” তাদের উত্তর ছিল, “এখন তুমি জানাতে পারো। তোমাকে নেওয়া হয়েছে।”’

তারপর?

‘সেই মুহূর্তে বাবার সামনে গিয়ে আমি লাফাতে শুরু করি। উত্তেজনায় বলে বসি, “বাবা, তোমার মেয়ে পোল্যান্ড যাচ্ছে।”’ সবকিছু ঠিক থাকলে ১৫ মে পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের এই স্নাতক।

এ ধরনের থ্রি ডি মডেল তৈরি করেন অঙ্কিতা

অঙ্কিতার মাথায় গেমের পোকা অবশ্য ঢুকেছে বহু আগেই। ছোটবেলা থেকে গেমই ছিল ধ্যানজ্ঞান। গেমিংয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন সারাক্ষণ। বাড়ির আশপাশে যেখানেই কম্পিউটার মিলত, বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে গেম খেলতেন। একজনের ‘গেম ওভার’ হয়ে গেলে আরেকজন খেলবে, এই ছিল অলিখিত নিয়ম। তখন গেম বিষয়টা এমনভাবে আকর্ষণ করত, কারও হাতে ফোন দেখলেই অঙ্কিতা জিজ্ঞেস করতেন, ‘আপনার ফোনে গেম আছে? দেখি তো!’

স্কুল-কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে এসেও অঙ্কিতার আগ্রহে ভাটা পড়েনি। ছোট থেকেই চাইতেন, এমন কাজ করবেন, যা ভালো লাগে। পড়ালেখার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম! ইচ্ছা ছিল প্রকৌশলে পড়বেন এবং তা কম্পিউটারবিজ্ঞান। হয়েছেও তা–ই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক করেছেন তিনি।

ইলেভেন বিট স্টুডিওজের প্রতি আগ্রহ হলো কেন? অঙ্কিতার উত্তর, ‘ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই টানত। আবার যেসব কোম্পানি কম্পিউটার গেম বানায়, তাদের প্রতিও আগ্রহ ছিল।’

শুরুতে ত্রিমাত্রিক ছবি আঁকা (থ্রিডি আর্ট) সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না। একসময় থ্রিডি আর্ট, টুডি আর্ট, প্রোগ্রামিং, ইউআই (ইউজার ইন্টারফেস), অর্থাৎ একটা গেম তৈরিতে যা যা দরকার, সবই টুকটাক করতে শুরু করেন। যদিও সেসব ছিল একেবারেই নবিশ পর্যায়ের। এরপর ‘আলফা পটেটো’ নামে বাংলাদেশের একটি মোবাইল গেম কোম্পানিতে যখন ইন্টার্নশিপের সুযোগ এল, বুঝেশুনে বেছে নেন থ্রিডি আর্টের কাজ।

ত্রিমাত্রিক মডেল বানাতে গিয়েও কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। হাতে ছিল পুরোনো কনফিগারেশনের ল্যাপটপ, কাজ শেখার জন্য যা কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়। যা আছে তা দিয়েই তিনি চেষ্টা করে গেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেম ল্যাবটা তাঁর খুব কাজে এসেছে। এই ল্যাবে উন্নত ডেস্কটপ কম্পিউটার ছিল, ইন্টারনেট সংযোগও খুব শক্তিশালী। অনেক সময় ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, দিনরাত এ ল্যাবেই পড়ে থাকতেন অঙ্কিতা।

নিজের ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিয়েই এত দূর পথ পেরিয়েছেন। ভবিষ্যতের দিনগুলোতেও মনের কম্পাসটাকেই অনুসরণ করতে চান তিনি।