‘আম্মুকে দেখলাম, গ্যালারিতে বসে হাততালি দিচ্ছে’
ক্লাসে ‘রাফিয়া’ ছিল বেশ কয়েকজন। তাই স্কুলে রাফিয়া বিনতে আলমের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ফার্স্ট গার্ল রাফিয়া’। হবে না! দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি বাদে সব শ্রেণিতেই যে রোল নম্বর ১। চট্টগ্রামের বেলস গার্লস হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় সে পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীর স্বীকৃতি।
চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে এখন রাফিয়া। শুধু ভালো ছাত্রী নয়, ভালো বিতার্কিক, ভালো আবৃত্তিকার, ভালো আঁকিয়ে, এমনকি ভালো রন্ধনশিল্পী হিসেবেও তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০২৩-এর জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় ‘একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি’ গ্রুপ থেকে একক বিতর্কে প্রথম হয়েছে রাফিয়া।
আর রান্নায় সুনামের ‘ঘ্রাণটা’ কীভাবে ছড়াল?
ছোটবেলা থেকে রান্নাবান্নায় আগ্রহ ছিল। মাকে সঙ্গ দিতে দিতেই বিভিন্ন রান্নার কৌশল শিখে নিয়েছে সে। টেলিভিশনে কার্টুন নয়, রান্নার অনুষ্ঠান ছিল প্রথম পছন্দ। মনোযোগী ছাত্রীর মতো রেসিপি টুকে রাখত সে। একদিন প্রথম আলোয় ‘তীর লিটল শেফ সিজন ২’–এর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে মা সুলতানা আলমের। তাঁর আগ্রহেই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় রাফিয়া। যদিও শুরুতে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কারণ রাফিয়া ভাবছিল, ‘আমি তো এখনো অত পাকা হইনি।’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য নবিশ হাতে রান্না করেই প্রতিযোগিতার শেষ ধাপে সারা দেশ থেকে আসা ৩০ রন্ধনশিল্পীর মধ্যে ‘ফার্স্ট গার্ল রাফিয়া’ খেতাব বজায় রাখে সে, হয় চ্যাম্পিয়ন!
২০২০ সালে পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসবে যে দল সেমিফাইনালে উঠেছিল, সেই দলের নেতৃত্বে ছিল সে সময়ের নবম শ্রেণিপড়ুয়া রাফিয়া। পরের বছর বিএফএফ-সমকাল জাতীয় বিজ্ঞান বিতর্ক উৎসবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম রানারআপ হয় সে। আর এ বছর তো জাতীয় পর্যায়ের বিতর্কে প্রথম স্থানই পাওয়া হয়ে গেল। পুরস্কার হিসেবে ক্রেস্ট, সনদ, মেডেল ছাড়াও ১০ হাজার টাকা পেয়েছে এই বিতার্কিক। রাফিয়া বলছিল, ‘শিক্ষামন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করার অনুভূতি অন্য রকম। আম্মুকে দেখলাম, গ্যালারিতে বসে হাততালি দিচ্ছে। আপুরা সেখানে ছিল। সবাইকে খুশি হতে দেখেছি, এটাই আমার আসল পাওয়া।’
আবৃত্তি দিয়েই রাফিয়ার সহশিক্ষা কার্যক্রমের শুরু। চর্চাটা এখনো ধরে রেখেছে। পাশাপাশি ছবি আঁকাতেও তার হাত আছে। চিত্রাঙ্কনে পেয়েছে বেশ কিছু পুরস্কার। এ ছাড়া ন্যাশনাল বিজনেস অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয়, পাই মেমোরি অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় এবং বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের ২০২২ ও ২০২৩ সালের আসরে আঞ্চলিক পর্যায়ে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও প্রথম রানারআপ হয়েছিল রাফিয়া বিনতে আলম।
পড়ালেখার পাশাপাশি এত কিছুর সময় ব্যবস্থাপনা করাই সবচেয়ে কঠিন বলে মনে করে রাফিয়া। বলছিল, ‘একে তো পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপ, সঙ্গে সবার একটা প্রত্যাশা আছে। এই প্রত্যাশাও কখনো কখনো চাপ হয়ে যায়। নিজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা চলে আসে, যদি না পারি! তাই সব সময় আমার সেরাটা দিতে চেষ্টা করি।’
ফেসবুকে ‘রাফিয়া’স হাংরিল্যাব’ লিখে সার্চ দিলেই একটা অনলাইন ফুড স্টোরের দেখা মেলে। যেখানে বিভিন্ন স্বাদ ও নকশার কেক ও পিৎজা বানায় রাফিয়া। আবার মহাকাশের প্রতি অনুরাগ থেকে নাসা গ্লি মিশন বাংলাদেশ দলের সায়েন্স অ্যান্ড মিশন কন্ট্রোল বিভাগের সদস্যও হয়েছে এই শিক্ষার্থী। ভবিষ্যতে রন্ধনশিল্পী হবে, না মহাকাশচারী—সেটা অবশ্য এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি। হেসে বলছিল, ‘যেখান থেকে বাংলাদেশের মানুষকে গর্বিত করতে পারি, সেখানেই পৌঁছাতে চাই।’