শ্যারেন্টিং করে শিশুর যে ক্ষতি ডেকে আনছেন

সন্তানকে অনলাইনের কনটেন্ট বানানোর ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। মডেল: নিশাত ও আরাশছবি: সুমন ইউসুফ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের সন্তানদের জীবন ভাগাভাগি করে নেওয়া নতুন কিছু নয়। কিন্তু সন্তান যখন আপনার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বড় একটা অংশ হয়ে পড়ে, তখন তা অজান্তেই ডেকে আনতে পারে বিপদ। সন্তানের ছবি বা ভিডিওকে কনটেন্ট বানিয়ে আপনি আসলে শ্যারেন্টিং করছেন।

‘শ্যারেন্টিং’ মূলত একটি সন্ধি শব্দ। ‘শেয়ারিং’ ও ‘প্যারেন্টিং’—এই শব্দ দুটির মিশ্রণে তৈরি হয়েছে ‘শ্যারেন্টিং’। এটি অতিরিক্ত ডিজিটাল শেয়ারিংয়েরই আরেক রূপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বেশির ভাগ মানুষই অতি তৎপর। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিয়মিতই ভাগাভাগি করতে থাকেন নিজেদের ছবি, প্রতিদিনকার ঘটনাবলি। কিন্তু এটাই যখন নিজেদের ছাড়িয়ে সন্তানদের গণ্ডিতে প্রবেশ করে; সন্তানের ছবি ও দৈনন্দিন ঘটনায় ছেয়ে যায় টাইমলাইন, তখনই সেটা শ্যারেন্টিং।

কীভাবে শুরু হয়  

ভেবে দেখুন তো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত এক বছরে কতজনের সন্তান জন্মের সংবাদ পেয়েছেন? পরে তাঁদের প্রোফাইল থেকে না চাইতেও কনটেন্ট আকারে নিয়মিত সামনে আসছে সন্তানের আপডেট, কী খাচ্ছে, কী করছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে নাকি হাঁটতে পারছে, এমন সব তথ্য। সেই কনটেন্ট দেখে আপনি হয়তো খুশিই হচ্ছেন। যে অভিভাবক শিশুর ছবি-ভিডিও পোস্ট করছেন, তাঁদের মাথাতেও হয়তো একই ভাবনা—আনন্দ। এভাবেই শ্যারেন্টিংয়ের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে মা-বাবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুরোটাই দখল করে নেয় সন্তানেরা। তারাই হয়ে ওঠে মূল কনটেন্ট। তাদের স্কুলজীবন, প্রতিদিনের কার্যকলাপ, মজার ঘটনা, দুঃখের ঘটনা; একে একে সবই ঠাঁই পায় ফেসবুকের পাতায়। অনেকে আবার স্মৃতি হিসেবে নিয়মিত ছবি, গল্প শেয়ার করে রাখেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই করে তোলেন ব্যক্তিগত ডিজিটাল আর্কাইভ। সঙ্গে ডেকে আনেন সন্তানের বিপদ।

কী বিপদ

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই অনেকে করে তোলেন সন্ব্যতানের ব্যক্তিগত ডিজিটাল আর্কাইভ
ছবি: সুমন ইউসুফ

শ্যারেন্টিংয়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার জন্য সন্তানকে ইন্টারনেট সেনসেশন হওয়ার প্রয়োজন নেই। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। মা–বাবার ভালো লাগা, পছন্দ-অপছন্দ অজান্তেই আপন করে নেয় তারা। বাবা-মায়ের কল্যাণে তাদের জীবনের প্রতিটি তথ্য এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। ইন্টারনেটের বন্ধুরাই যখন প্রথমবারের মতো সামনে আসে, তখন মনের অজান্তেই আপনার সন্তানের একটা ইমেজ তৈরি করে তারা। সেই ইমেজ ধরে রাখতে না পেরে শিশু নিজেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এ ছাড়া প্রত্যাশার একটা আলাদা চাপ তৈরি হয় শিশুদের মনে। পাশাপাশি রয়েছে নেতিবাচক পোস্ট। সন্তানদের পরীক্ষার ফলাফল, তাদের নিয়ে করা হাসি-ঠাট্টা কিংবা মজার ঘটনাও অনেকে ইন্টারনেটে শেয়ার করেন। আপাতদৃষ্টে ঘটনাটা মজার মনে হলেও সন্তানের জন্য হয়তো তা মজার নয়। মা–বাবা থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের হাজারো মানুষের হাসি-ঠাট্টা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে শিশুর মানসিকতায়। শিশুর বেড়ে ওঠার বয়সে সবচেয়ে ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে এই হাসি–ঠাট্টা।

বেশি বেশি ছবি-ভিডিও-তথ্য সন্তানের গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎকে শঙ্কার মধ্যে ফেলতে পারে। একটা সময় ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে মা–বাবার কাছ থেকে তথ্য লুকানোর চেষ্টা করে সন্তান। তাই নিজের অজান্তেই সন্তানের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে পারেন আপনি।

অন্য বিপদ

শ্যারেন্টিং যে শুধু সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে তা–ই নয়। বরং সন্তানের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে পড়ে। ইন্টারনেটে কোনো তথ্য দেওয়া মানেই পৃথিবীর সবার জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়া। ফেসবুকে যখন সন্তানের স্কুলের ফলাফল নিয়ে আহ্লাদ করছেন, তখন আপনার অজান্তেই কেউ না কেউ আপনার সন্তানের স্কুলের সব তথ্য জেনে যাচ্ছে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আনন্দ করার ছবি যখন ইন্টারনেটে দিচ্ছেন, তখন তা দেখতে পারছেন যে কেউ। ডিজিটাল যুগে সব তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত। চাইলেই বিকৃত মানসিকতার যে কেউ তা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেন। এতে শুধু নিজের সন্তান নয়, তার বন্ধুবান্ধবকেও ঝুঁকির মুখে ফেলছেন।

তাহলে কি একেবারেই শেয়ার করা যাবে না

যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখে শেয়ার করা যেতেই পারে। অনেকেই এখন নিজেদের সন্তানের মুখ ঢেকে রেখে ছবি পোস্ট করেন। কেউ আবার সন্তানের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রেখে গল্প করেন। স্কুলের ফলাফল বললেও স্কুলের নাম গোপন রাখেন, ছবি দেওয়ার আগেই যথেষ্ট দেখভাল করে নেন, যাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য বেহাত না হয়ে যায়।

অনেক মা-বাবা শ্যারেন্টিং শুরু করেন মনের অজান্তেই। শুরুটা হয়তো হয় সন্তানের দু-একটা ছবি পোস্ট করে। আস্তে আস্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে থাকে শুধু সন্তানের গল্প আর ছবি। শ্যারেন্টিং প্রতিরোধ করার জন্য তাই নিজেদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সন্তানের দেখভাল করার সময় যেমন নিজেকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন, তেমন ইন্টারনেট দুনিয়ায় তাকে হাজির করার আগেও প্রশ্ন করুন।

শিশুর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়ার আগে সচেতন হওয়া জরুরি
ছবি: সুমন ইউসুফ

আপনার সন্তানের কোন তথ্য মানুষের জানার প্রয়োজন আছে আর কোনটার নেই, সেটি পার্থক্য করতে শিখুন। কোন ছবিটা স্মৃতি আর কোন ছবিটা সবাইকে দেখানোর জন্য, সেই পার্থক্য বুঝতে শুরু করুন। যাদের সঙ্গে তথ্যগুলো শেয়ার করছেন, তারা কতটা কাছের? তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করেন তো? আজ থেকে কয়েক বছর পর যখন আপনার সন্তান ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, তখন এই ছবিগুলো তাকে বিব্রত করবে না তো? সন্তানের কোনো তথ্য বা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করার আগে নিজেকে এই প্রশ্নগুলো করুন।

ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলি আর অভিনেত্রী আনুশকা শর্মা জুটিকেই দেখুন না। দুই দুনিয়ার সেরা দুই তারকা, ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের মা–বাবা। অথচ তাঁদের সন্তানের কোনো স্পষ্ট ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেই। পাপারাজ্জিরা শত চেষ্টা করেও দু–একটা অস্পষ্ট ছবি ছাড়া কিছু বের করতে পারেননি। তাদের নাম বাদে কোনো তথ্যই ইন্টারনেটে উন্মুক্ত নয়। নামকরা সেলিব্রিটি হয়েও নিজেদের সন্তানের গোপনীয়তা ধরে রেখেছেন তাঁরা। ডিজিটাল যুগে এসেও যদি সময়ের সেরা দুই তারকা নিজেদের সন্তানের গোপনীয়তা ধরে রাখতে পারেন, তবে আপনি কেন পারবেন না?

কথাগুলো শুধু মা-বাবাই নয়, বরং তাঁদের বন্ধুবান্ধবের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। কেউ যদি প্রয়োজনের বাইরে সন্তানের অতিরিক্ত ছবি কিংবা তথ্য শেয়ার করে, তাকে সতর্ক করুন। ডিজিটাল যুগে এসে সতর্কতাই পারে শ্যারেন্টিংকে রুখে দিতে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পড়তে পারে এই ওভারশেয়ারিংয়ের প্রভাব। আপনার সন্তানের একটা ভালো মুহূর্তও অন্যকে কষ্ট দিতে পারে, করে তুলতে পারে প্রতিহিংসাপরায়ণ।

এই ওভারশেয়ারিংয়ের কারণে নষ্ট হতে পারে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের স্বাভাবিক সম্পর্ক। অনেক সময় ভিডিওতে সন্তান বিরক্ত হচ্ছে, সেটাও আপনি আপলোড দিলেন, এতে তার মানসিক কষ্টটা আরও বাড়বে। 

এই ওভারশেয়ারিং যে সব সময় সন্তানকে কনটেন্ট বানানোর চিন্তা থেকে আসে, তা নয়। বরং মা-বাবা নিজের অজান্তেই অনেক সময় শিশুদের এসব তথ্য অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। সেটা করার আগে তাই অবশ্যই পরের সময়টার কথা ভাবতে হবে।

আরও পড়ুন