কারমাইকেল কলেজের লিচুতলায় বিতর্কচর্চার তিন দশক
শানবাঁধানো বসার স্থান ও মঞ্চ তখন ছিল না। লিচুতলায় ছিল সবুজ ঘাস। সেই ঘাসের ওপর পাটের চট বিছিয়ে বসতে হতো। লোহার তৈরি ভ্রাম্যমাণ ডায়াস (মঞ্চ) বসিয়ে প্রতি সপ্তাহে চলত বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি ও শুদ্ধ উচ্চারণের চর্চা। আলোচনা করা হতো সাধারণ জ্ঞানসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে।
দীর্ঘ তিন দশক ধরে সেই একই লিচুতলায় খোলা আকাশের নিচে এখনো চর্চা অব্যাহত আছে। তবে এখন চটের জায়গায় স্থায়ী বসার ব্যবস্থা হয়েছে, ভ্রাম্যমাণ মঞ্চের জায়গায় নির্মিত হয়েছে পাকা মঞ্চ। বছর বছর শুধু মানুষ বদলেছে, চর্চাটা রয়েই গেছে।
উত্তরবঙ্গের শতাধিক বছরের পুরোনো বিদ্যাপীঠ রংপুর কারমাইকেল কলেজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্যবাহী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বিতর্ক পরিষদ’। এর সদস্যরা এবার নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে লিচুতলায় বিতর্কচর্চার তিন দশকে পদার্পণ উদ্যাপন করেছেন।
‘বিতর্কের দ্বন্দ্বে বিকশিত হোক সুন্দর’ স্লোগান নিয়ে ১৯৯৩ সালের ২ অক্টোবর বিতর্ক পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এত বছরে লিচুগাছটির যেমন শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি লিচুতলার ছায়ায় একসময় বিতর্কে ঝড় তোলা বিতার্কিকেরা এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা পেশায় নিয়োজিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
বিতর্ক পরিষদ ও লিচুতলার বিতর্কচর্চা জীবনের বাঁক বদলে দিয়েছে বলে বিশ্বাস করেন কলেজটির প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বিতার্কিক হাসান কবীর। তিনি ৩৩তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডার। বর্তমানে কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক ও বিতর্ক পরিষদের তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষক। হাসান কবীর বলেন, বিতর্ক করতে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে জানতে হয়। বিতার্কিককে সব সময় সব বিষয়ে হালনাগাদ থাকতে হয়, যা যেকোনো চাকরির পরীক্ষা মোকাবিলা করতে সহায়ক। তা ছাড়া বিতর্ক করতে গিয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, মঞ্চে কথা বলার অভ্যাস তৈরি হয়। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে, চাকরির ভাইভা বোর্ড মোকাবিলা করা সহজ হয়।
বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ তৈরির লক্ষ্যে বিতর্ক পরিষদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিন দশকে অসংখ্য বিতার্কিক এখান থেকে বেরিয়ে গেছেন। পেশাগত জীবনে তাঁরা এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।
প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার বেলা ১১টায় কলেজের বাংলা বিভাগের সামনে লিচুতলায় বিতর্ক পরিষদে অনুশীলন শুরু হয়, চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। পরিষদের বর্তমান মুখ্য সমন্বয়ক এস এম আল আমীন ও সাধারণ সম্পাদক জয় লালার নেতৃত্বে সংসদীয় বিতর্ক, প্রচলিত বা সনাতনী বিতর্ক, বারোয়ারি বিতর্ক, রম্য বিতর্ক, প্লানচেট বিতর্ক চর্চা করা হচ্ছে। আসাদ, জান্নাতুল ফেরদৌস, রেজোয়ান, সোহান, ওসমান, নন্দিতা, লাবনী, মাহামুদুল, সঞ্জয়, তিথি, নীতি, শামীম, মৌরিন, নোশীন, মাইদুল, শ্রেষ্ঠা, চিত্রা, স্নেহা, হৈমন্তী, তমা, প্রীতি, বিথীসহ ৩৫ থেকে ৪০ সদস্য নিয়মিত বিতর্কচর্চায় অংশ নেন। সাধারণ সম্পাদক জয় লালা বলেন, ‘বিতর্কের দ্বন্দ্বে সত্য ও সুন্দর পৃথিবীর প্রকাশই আমাদের কাম্য।’
বিতর্কচর্চায় শুধু উত্তরবঙ্গে নয়, আন্তবিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় পর্যায় ও টেলিভিশন বিতর্কে সাফল্য আছে কারমাইকেল কলেজের বিতার্কিকদের। সেই সঙ্গে বিতর্ক কর্মশালার আয়োজন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিতর্ক প্রশিক্ষণ দান, বিতর্ক বিষয়ে বিশেষ ম্যাগাজিন মনীষা প্রকাশ করেন তাঁরা।
কলেজটির বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিতর্ক পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ তৈরির লক্ষ্যে বিতর্ক পরিষদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিন দশকে অসংখ্য বিতার্কিক এখান থেকে বেরিয়ে গেছেন। পেশাগত জীবনে তাঁরা এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।
তৎকালীন শিক্ষার্থী শাহ মো. রেজাউল ইসলাম, সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ, মোহাম্মদ হানিফ, কামরুল হুদা, নজরুল ইসলাম, নীলিম মহসীন রেজা, মিথী প্রধান, নূরল ইসলামসহ বেশ কিছু তরুণ শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টায় বিতর্ক পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরিষদের প্রথম মুখ্য সমন্বয়ক রেজাউল ইসলাম বর্তমানে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বড়ুয়াহাট বি এম কলেজের অধ্যক্ষ। তিনি বলেন, নব্বই দশকে কলেজে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা স্থবির হয়ে পড়ে। প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যেই তাঁরা বিতর্ক পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন।
বিতর্ক পরিষদের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজটিতে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কানাসাস, স্পন্দন, কাকাশিস ও আবৃত্তি সংসদ সক্রিয় আছে। এ ছাড়া রোভার স্কাউট ও বিএনসিসি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কলেজটির অধ্যক্ষ ও পদাধিকার বলে বিতর্ক পরিষদের সভাপতি মো. আমজাদ হোসেন বলেন, পুরোনো এই কলেজের ঐতিহ্য ও গৌরব ধরে রাখতে বিতর্ক পরিষদ, বাঁধনসহ বিভিন্ন সংগঠন ভূমিকা রাখছে। কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংগঠনগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে।