আঙ্কেল বলেছিলেন, ‘বাবা, আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশ হয়ে উঠেছিল উত্তাল। এই অস্থির সময়ে অনেক শিক্ষার্থীই হারিয়েছেন তাঁদের সতীর্থকে। পড়ুন এমনই এক বন্ধুর শোকগাথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়াকে নিয়ে লিখেছেন তাঁরই বন্ধু হারুন-অর-রশিদ
দিনটা ছিল সম্ভবত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২। তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলের বর্ধিত ভবনে থাকি। বন্ধু তৌকি ফোন করে বলল, ‘আমি তো হলে নেই; আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন বন্ধু আসবে। সে আমাদের হলেই উঠবে। তোর নাম্বার ওকে দিয়েছি। কল দিলে ওকে রিসিভ করিস।’
হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার সঙ্গে সেদিনই প্রথম দেখা। বাবাকে নিয়ে হলের গেটে দাঁড়িয়ে ছিল ও। আমরা একই সেশন, একই বিভাগ। অতএব বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না। আঙ্কেলসহ ওকে নিয়ে রুমে গেলাম। আঙ্কেল অনেক গল্প করেছিলেন সেদিন। বলেছিলেন, ‘বাবা, ও আমার একমাত্র ছেলে। ওকে তোমাদের কাছে রেখে গেলাম। তোমরা সবাই একসঙ্গে থেকো। ওকে একটু দেখে রেখো।’
আমিও খুব উৎসাহ নিয়ে বলেছিলাম, ‘কোনো সমস্যা নেই আঙ্কেল।’ কিছুক্ষণ পর তৌকি এল। তৌকিকেও হৃদয়ের বাবা একই কথা বলেছিলেন। সেদিন একসঙ্গে ঘুরতে বেরোলাম। ক্যাম্পাসে ঘুরলাম। এভাবেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু। ক্যাম্পাসের এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে আমি আর তরুয়া একসঙ্গে যাইনি। আহা, কী সুন্দর ছিল সেই সব সময়!
‘ছিল’ বলতে হচ্ছে, কারণ, আমার বন্ধুটা আর নেই। ১৮ জুলাই শহরে টিউশনি করতে গিয়েছিল। সেখানেই গুলিতে আহত হয়। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে অবশেষে ২৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে মারা যায়।
তরুয়া সবার চেয়ে একটু আলাদা ছিল। কখনো কাউকে তেল দিয়ে চলত না। ওর যেটা ভালো লাগত সরাসরি বলে দিত, যেটা লাগত না সেটাও মুখের ওপর বলে দিত। ওর পরিচিতির গণ্ডিটা ছোট ছিল। কিন্তু যাদের সঙ্গে মিশত, একদম মন খুলেই মিশত। এই ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে আমি একজন।
আমরা বন্ধুরা ওকে অসামাজিক ডাকতাম। আর ও খুব সহজেই সেটা মেনে নিত। আমাকে বলত, ‘সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ইচ্ছা করে না।’ মাঝেমধ্যে আমাকে খুব জ্বালাতন করত, খ্যাপাত। আমি রেগেও যেতাম। কিন্তু ও হাসত। বলত, রাগ করলেও আমি তোকে খ্যাপাব। আমি রাগ করে থাকতে পারতাম না। দু-একটা গালি দিয়ে ঠিকই হেসে ফেলতাম।
আমার বন্ধুটা অনেক সংগ্রাম করে এত দূর এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই টিউশনি করে নিজের খরচ চালাত। মাঝেমধ্যে ওকে খুব বকতাম। কারণ, শুক্রবারগুলোতেও সকাল ৯টার শাটলে ও টিউশনিতে যেত, ফিরত বিকেলে। তরুয়া অনেক হিসাব করে চলত। কারণ, ও জানত, বাড়ি থেকে টাকা আনার পরিস্থিতি তার নেই। এমনও দেখেছি, যেদিন বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে, সে রাতে কলা–রুটি খেয়ে থেকেছে। বাসায় যেতে চাইত না, সে জন্যও বকতাম। তরুয়া বলত, ‘বাসায় গিয়ে কী করব বল? তার থেকে এখানেই থাকি। টিউশনি তো মিস করা যাবে না।’
সারা দিন টিউশনি করে এসেও তরুয়া রাতভর পড়ত। পড়ালেখা শেষ করতে হবে, পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে, কত ভাবনা ছিল। সংগ্রাম যার সঙ্গী ছিল, আমার সেই বন্ধুটাই কিনা হার মানল বুলেটের কাছে!