নিজের হাতের ঘড়িটাই আব্বা আমাকে খুলে দিয়ে দিলেন
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসাবে কাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে পাঠকের কাছে লেখা চেয়েছিল ‘ছুটির দিনে’। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন অনেক পাঠক। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।
ম্যাট্রিক পাস করে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়েছি। আব্বা পাবনা জজকোর্টে ওকালতি প্র্যাকটিস করেন। আমার উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁর অনেক ইচ্ছা আর আকাঙ্ক্ষা। আমার হাতঘড়ি নেই। কিন্তু নতুন ঘড়ি কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও তখন আব্বার নেই। নিজের হাতের ঘড়িটাই খুলে আমাকে দিয়ে দিলেন আব্বা।
আমরা ভাইবোনরা সবাই অবাক। আব্বার বিয়ের সময়ের ঘড়ি। সে সময়ের নাম করা কোম্পানি ওয়েস্ট এন্ড কোম্পানির বিলেতি ঘড়ি। ছোটবেলা থেকেই আমি সেটা খুব পছন্দ করতাম। আমাকে ঘড়িটি দেওয়ায় মা খুব খুশি।
এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিএসসি পাস করে ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হলাম। এর মধ্যে সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে এল। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। আমাদের ক্লাসের সবাই উদ্বিগ্ন। ক্লাস আর হবে কি না, কোনো ঠিক নেই।
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আমাদের বিভাগীয় প্রধান ডক্টর আতিকুজ্জামান স্যার বলে দিলেন, যে যেখানে যে অবস্থায় থাকো না কেন, প্রতিদিনের ঘটনা ডায়েরিতে লিখে রাখবে। এর মধ্যে আমার হাতঘড়িটা কেন যেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। নিউমার্কেটে আমার চাচার (চিত্রপরিচালক মহি উদ্দিন) খুব পরিচিত একটা ঘড়ির দোকান ছিল। সেখানে সারাতে দিয়ে আসি।
২৫ মার্চের কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমরা পাবনায় চলে যাই। ৯ এপ্রিল বিকেলে আব্বার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারতে প্রবেশের জন্য পশ্চিম সীমান্তের দিকে রওনা দিই। মুক্তিযুদ্ধের জন্য কী করা যায়, এর মধ্যেই চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিলেন আব্বা। পরে এসব জানত পেরেছিলাম। শুধু জানতে পারিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১১ এপ্রিল আব্বাসহ আরও ৮ কি ১০ জনকে আমাদের পাড়ার পুকুরপাড়ে গুলি করে হত্যা করেছে।
সেটা আমি জানতে পেরেছিলাম তিন মাস পরে, বড় মামার চিঠিতে। কানাডা থেকে চিঠিটা এসেছিল। আমি তখন শরণার্থীশিবির বা পরিচিতজনদের বাসায় বাসায় ঘুরছি।
যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এলাম। মা বললেন, ‘আমাদের কোনোভাবে চলে যাবে। তোমার আব্বা যখন দেখে গেছেন তুমি সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়েছ, তখন যত কষ্টই হোক না কেন মাস্টার্সটা করো।’
এরপর আবার পড়াশোনা। সঙ্গে টিউশনি। রেডিওতে সংবাদ বিভাগে কিছু কাজ। এভাবেই চলছিল। এরপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেছে। বিদেশে স্কলারশিপ পেয়েছে। চলে যাওয়ার আগে আমার জন্য খুব দামি একটা ঘড়ি কিনে এনে দিয়েছে। ঘড়িটা এতই সুন্দর যে যতবার তাকাই শুধু আব্বার দেওয়া ঘড়ির কথাই মনে পড়ে। যুদ্ধের পরে নিউমার্কেটের সেই দোকানে গিয়ে আব্বার দেওয়া ঘড়িটা আর পাইনি। লুট হয়ে গিয়েছিল। ছেলের দেওয়া ঘড়িটা এখন যতবার পরতে যাই, ততবারই আমার শহীদ আব্বার (শফি উদ্দিন) কথাই মনে পড়ে।