ফুটবলে কেন সবুজ কার্ড থাকা উচিত
নাদিয়া নাদিমের জন্ম আফগানিস্তানে। ১২ বছর বয়সে শরণার্থী হয়ে আসেন ডেনমার্কে। এখন ডেনমার্কের জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্লাবেরও তিনি স্ট্রাইকার। জীবনের অনেক কঠিন সময় পেরোতে ফুটবল কীভাবে সাহায্য করেছে, নিজেই সে কথা লিখেছেন প্লেয়ারস ট্রিবিউনে।পড়ুন তাঁর সেই লেখারই নির্বাচিত অংশ।
সপ্তাহখানেক আগে স্পেনের স্যাভেলে শিশুদের একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানকার শিশুরা আমাকে নতুন একটা নিয়ম শেখাল। আমার মতে যেটা ফুটবলের অংশ হওয়া উচিত।
ফুটবলে লাল আর হলুদ কার্ড আছে। এই শিশুরা আমাকে বলল সবুজ কার্ডের কথা।
প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি। এ রকম কিছু কখনো শুনিনি। পরে তারা বুঝিয়ে বলল। কোনো খেলোয়াড় যদি পড়ে যায়, তুমি যদি তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো, তাহলে তোমাকে সবুজ কার্ড দেখানো হবে। দারুণ না! সমানুভূতি প্রকাশের চমৎকার উপায়।
আমার মনে হয় মানুষকে এক করার জন্য, শিক্ষিত করার জন্য ফুটবলকে আরও নানাভাবে ব্যবহার করা যায়। সবাই যেহেতু খেলাটার সঙ্গে একাত্ম হতে পারে, এর ইতিবাচক শক্তিটা কাজে লাগানোর বিপুল সম্ভাবনা আছে। যেমন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে এক করা, সংহতির বার্তা দেওয়া।
একসময় ট্রাকটা থামল। ড্রাইভার আমাদের বলল, ‘নামো! জলদি নামো!’ আমাদের ফেলে সে একরকম পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর এক লোক সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে একটা কুকুর। মা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, আপনি কি বলতে পারেন আমরা কোথায়?’
‘আমরা কোথায়?’
একটু সহৃদয়তা যে মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, আমি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। ১২ বছর বয়সে শরণার্থী হিসেবে ডেনমার্কে পা রাখি, দিনটা আমি কখনো ভুলব না। সেদিনই একজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি সোজা আমাকে স্বর্গ কিংবা নরকে পাঠিয়ে দিতে পারেন। তিনি সহৃদয় হলে ডেনমার্কে আমি নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারব। আর না হলে আমাকে আবার কাবুলে ফিরে যেতে হবে, হয়তো মরতে হবে।
নিজের ঘর থেকে বিতাড়িত হওয়ার অনুভূতি কতটা ভয়াবহ, আপনার সঙ্গে না ঘটলে কখনোই তা বুঝবেন না। সহায়সম্বল সব বিক্রি করে আমাদের নিয়ে এক রাতে একটা মিনিভ্যানে চড়ে বসেছিলেন মা। গন্তব্য পাকিস্তান। মনে মনে শুধু দোয়া করছিলাম, কেউ আমাদের যেন না থামায়। যখন করাচি পৌঁছলাম, একজন দালাল আমাদের হাতে জাল পাসপোর্ট ধরিয়ে দিল।
অনেক পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম ইতালি। একটা অ্যাপার্টমেন্টের বেসমেন্টে আমাদের জায়গা হলো। জায়গাটা এতই বিচ্ছিরি যে ঘুমানোর চেষ্টাও আমরা করতাম না। কিছুদিন পর এক লোক এসে আমাদের একটা ট্রাকে তুলল। শুরু হলো অনন্তযাত্রা।
গুটিসুটি মেরে কত দিন ট্রাকে ছিলাম, জানি না। ভয়ে কিছু খেতাম না; কারণ, টয়লেট ছিল না। ভাবতে পারেন, একটা শিশুর জন্য অভিজ্ঞতাটা কতটা ভয়াবহ? ঘর নেই। গন্তব্য নেই।
একসময় ট্রাকটা থামল। ড্রাইভার আমাদের বলল, ‘নামো! জলদি নামো!’ আমাদের ফেলে সে একরকম পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর এক লোক সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে একটা কুকুর। মা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, আপনি কি বলতে পারেন আমরা কোথায়?’
জানলাম, আমরা ডেনমার্কে।
জীবনের সেরা খাবার
আমাদের সাহায্য দরকার ছিল। তাই কাছাকাছি একটা পুলিশস্টেশনে গেলাম। সেখানেই সেই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা। জানতাম না আমাদের কী হবে। আমাদের কি জেলে পাঠিয়ে দেবে? কাবুলে ফেরত পাঠাবে? এমন তো না যে একজন আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ট্রাক থেকে নেমেছি। তা ছাড়া ইংরেজি বা ড্যানিশ, কোনো ভাষাই জানতাম না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে দেখছিলাম, পুলিশ কর্মকর্তা মায়ের কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর পুলিশ কর্মকর্তা মুখ খুললেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে কী বললেন, কিছুই বুঝতে পারলাম না। একটু পর নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ফুড? হাংরি?’
আমরা প্রবল বেগে মাথা ওপর-নিচ করলাম। তাঁর গাড়িতে করে আমাদের একটা দোকানে নিয়ে গেলেন পুলিশ কর্মকর্তা। দুধ, টোস্ট আর কলা কিনে দিলেন। এত সুস্বাদু খাবার জীবনে কোনো দিন খাইনি।
সেই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে আমরা স্রেফ ‘আরেক দল শরণার্থী’ ছিলাম না। স্রেফ ‘আরও একটা নতুন ঝামেলা’ ছিলাম না। তাঁর সামনে নিজেদের মানুষ মনে হচ্ছিল। যদি সম্ভব হতো, সময় পরিভ্রমণ করে আমি আবার তাঁর কাছে ফিরে যেতাম। তাঁকে একটা সবুজ কার্ড দেখাতাম।
একেই বলে সহনশীলতা, সমানুভূতি। আপনি পছন্দ করেন আর না-ই করেন, এটাই সত্য যে আমরা সবাই এক দল। একই পৃথিবীর বাসিন্দা। প্রশ্ন হলো, কীভাবে এক হয়ে খেলতে হয়, সেটা আমরা জানি কি না।
এটা সম্ভব। ফুটবল কী করতে পারে, আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি।
একটাই ভাষা—ফুটবল
সেই পুলিশ কর্মকর্তা আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন একটা শরণার্থী ক্যাম্পে। সোমালিয়া, কঙ্গো, ইরাক, আরমেনিয়া, রাশিয়া থেকে আসা শরণার্থীরাও সেখানে ছিল। কেউ কাঁদত। কেউ ঝগড়া করত। কেউ পালিয়ে যেত।
একটা চিঠির জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করছিলাম আমরা। যে চিঠি বলে দেবে—আমরা এখানে থাকতে পারব, কি পারব না?
শরণার্থী শিবিরের সেই দিনগুলোতেই আমি ফুটবলের প্রেমে পড়ি। সকালে আমরা বাচ্চারা একটা স্কুলে গিয়ে ভাষা শিখতাম। এরপর লুকোচুরি খেলতাম, ফুটবল খেলতাম। ফুটবল ঠিকই আমাদের সবাইকে গ্রহণ করে নিল। আমরা একেকজন পৃথিবীর একেক প্রান্ত থেকে এসেছি। দেখতে ভিন্ন। ভাষা ভিন্ন। কিন্তু যখনই ফুটবলটা গড়াতে শুরু করে, নিমেষে একে অপরকে বুঝতে পারি। এক ঝলক তাকিয়ে, চোখের ইশারায় আমরা একে অপরকে বলে দিই কোথায় যেতে হবে, কোন জায়গায় বলটা পাস করব।
একটা দিশাহারা, বিভ্রান্ত সময়ে ফুটবল আমাদের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল। ফুটবল হয়ে উঠেছিল আমাদের ভালোবাসা, ভাষা। দিনের কয়েকটা ঘণ্টার জন্য ফুটবল হয়ে উঠেছিল ছুটির উপলক্ষ।
এই খেলা আমাদের পরিবারগুলোকেও এক করেছিল। আমরা সবাই আলাদা আলাদা ব্যারাকে থাকতাম, কিন্তু রান্নাঘর ছিল একটাই। প্রত্যেকের ভাষা ভিন্ন, তবু আমার মা অন্য মা-বাবাদের সঙ্গে গল্প করতেন। কীভাবে, জানি না। যখনই কোনো পরিবার ডেনমার্কে থাকার অনুমতি পেয়ে যেত, সবাই এক হয়ে রান্নাঘরে পার্টি করতাম।
কিছুদিন পর আমাদের হাতেও চিঠি এল। শেষ হলো সাত মাসের অপেক্ষা।
সেদিন থেকে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে আমি বহুবার দেখেছি, ফুটবল কীভাবে মানুষকে এক করে। ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাবের হয়ে আমি খেলেছি। দেখেছি, পৃথিবীর কোনায় কোনায় ফুটবলের জন্য মানুষ এক হয়েছে। ফুটবল এমনই জাদুকরী এক খেলা, যেটাকে শরণার্থী সংকটের মতো বড় সমস্যা মোকাবিলায়ও কাজে লাগানো যায়। পৃথিবীর সব খেলার মধ্যে ফুটবল মানুষের সবচেয়ে প্রিয়। যদি খেলতে জানো, তার মানে অন্তত একটি বৈশ্বিক ভাষা তোমার জানা।