ছাদবাগান থেকে প্রতিদিনের সবজির চাহিদা মিটে যায়
বাজার থেকে শাকসবজি, ফল কেনার সময় আমার মধ্যে বেশ আতঙ্ক কাজ করত, বিশেষ করে যখন আমার ছেলে পৃথিবীতে এল। সব সময় চাইতাম ও যেন সুস্থ, সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে। ক্ষতিকর রাসায়নিক, কীটনাশক দেওয়া শাকসবজি ও ফলমূল শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই তাকে শাকসবজি ও ফল খেতে দিতে গেলে বেশ ভয়েই থাকতাম। এখন যদিও অনেক জায়গায় অর্গানিক শাকসবজি ও ফল পাওয়া যায়, তবে দ্রব্যমূল্যর এই লাগামছাড়া বাজারে ঠিকমতো বেঁচে থাকাটাই যেখানে কষ্টকর, সেখানে ইচ্ছা থাকলেও বেশি দামে এগুলো কেনা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।
মোহাম্মদপুরের একটি ছোট্ট স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে আমার বাস। বাসার সামনে বিশাল খোলা ছাদ। সেখানে আছে সুন্দর বসার ব্যবস্থা। কিছু দূরেই একটা পার্ক, তাই একটুকরা সবুজও চোখে পড়ে। মন খারাপের বিকেলে এক মগ কফি নিয়ে ছাদে বসলে মন ভালো হতে বাধ্য। সঙ্গে বাড়িওয়ালার পরিকল্পনায় গাছ লাগানোর জন্য আছে নির্ধারিত স্থান। যেখানে টব ছাড়া সরাসরি মাটি ফেলে অনায়াসে শাকসবজির গাছ লাগানো যায়।
ছেলেকে অর্গানিক শাকসবজি ও ফল খাওয়ানোর জন্য এ যেন আমার কাছে এক সুবর্ণ সুযোগ হয়ে এল। ছোটবেলা থেকেই বাগান করার নেশা ছিল। তাই আর দেরি না করে ছাদবাগানে গাছ লাগানো শুরু করলাম। শহরে বাগান করতে গেলে টবের সীমিত পরিমাণ মাটিই ভরসা। তাই গাছের পরিপূর্ণ পুষ্টি জোগানোর জন্য সঠিকভাবে মাটি তৈরি করাটা জরুরি। যেহেতু পরিবারের পাতে রাসায়নিকমুক্ত শাকসবজি ও ফল তুলে দেওয়াটা আমার উদ্দেশ্য, তাই সম্পূর্ণ জৈবপদ্ধতিতে মাটি প্রস্তুত করতে চেষ্টা করি। সমান পরিমাণ শুকনা গোবর আর মাটি নিই, সঙ্গে যোগ করি ব্যবহৃত চা–পাতা, ডিমের খোসার গুঁড়া, সামান্য শর্ষের খইল, এক মুঠো নিমপাতাগুঁড়া, কোকো পিট বা নারিকেল ছোবড়াগুঁড়া, মোটা বালু। এগুলো মিলিয়ে শুকিয়ে নিই।
এবার টবের নিচের পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা ঠিক করে কিছু ইটের টুকরা বিছিয়ে নিই। তারপর এক স্তর মাটি ফেলে কাটাকুটির পর উচ্ছিষ্ট শাকসবজি, ফলের খোসা, ডিমের খোসা, চা–পাতা দিই। তারপর আবার এক স্তর মাটি দিই। এভাবে টবের সাইজ বুঝে দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ণ করে তার ওপরে বেশি করে মাটি দিই, তারপর গাছ লাগাই। ব্যস অনেক দিনের জন্য গাছ নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
গাছ অনুযায়ী নিয়মিত যত্ন কিছুটা আলাদা। এখানে আমি সাধারণ কিছু যত্নের নিয়ম জানাচ্ছি। কোনো গাছের গোড়ায়ই পানি জমতে দেওয়া যাবে না। মাটি ভেজা থাকা অবস্থায় গাছে আবার পানি দেওয়া যাবে না। প্রতিদিন যাতে পানি দেওয়া যায়, এমন পরিমাণে পানি দিতে হবে। গাছগুলো রোদ পায়, এমন জায়গায় রাখতে হবে। সকালে বা বিকেলে গাছে পানি দেওয়া ভালো, দুপুরের রোদে পানি দেওয়া উচিত নয়।
ছাদবাগান আর বারান্দাবাগানের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো মিলিবাগসহ বেশ কিছু পোকা। ছাদবাগানের নিমগাছ থেকে পাতা নিয়ে পানিতে ফুটিয়ে সেটা স্প্রে করি। কিছুদিন পরপর মাটি একটু খুঁচিয়ে আগাছা তুলে ফেলি। চার মাস পরপর টবের মাটির ওপর থেকে দুই ইঞ্চির মতো তুলে ফেলে শুকনো গোবর আর জৈব সার মিশিয়ে দিই। এই জৈব সার আমার ছাদবাগানেই তৈরি করি। তৈরির পদ্ধতি পরে বলছি। যেহেতু শহরের ছাদে বাগান, তাই জায়গার স্বল্পতা থাকে। তাই কোনো গাছের সাথি ফসল সম্পর্কে খোঁজ করে সেই অনুযায়ী গাছ লাগাতে থাকি। ১২ মাসি টমেটো গাছ লাগাই। এখন আর বাজার থেকে টমেটো কিনতে হয় না।
তেমনি শসা, বেগুন, করলা, লাউশাক, বরবটি, শিম, কয়েক রকম মরিচ ইত্যাদি সবজি গাছ থাকলে ৩ বা ৪ জনের পরিবারের সবজি চাহিদা অনেকটাই মিটে যায়। এসব গাছের নিচে ধনেপাতা, বিলেতি ধনে, পুদিনাপাতা, লালশাক, কলমিশাক, স্ট্রবেরি, অ্যালোভেরা এসব গাছ লাগিয়ে দিলে এক টব থেকেই একাধিক জিনিস পাওয়া যায়।
ঘরে যেভাবে জৈব সার বানাই তা–ও আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি। চায়ের লিকার বানিয়ে সেই পাতাটা ছেঁকে শুকিয়ে নিই, গাছের জন্য এটা সবচেয়ে সেরা সার। দুধচিনিসহ চা জ্বাল করলে ভালো করে পাতাটা ধুয়ে নিতে হবে। ডিমের খোসা ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে নিতে হবে। এত ঝামেলা না করতে চাইলে রেডি অবস্থায় নার্সারি বা অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায়। জৈব সার বানানোর আরেকটি পদ্ধতি হলো, একটা বড় পাত্রে মাটি দিয়ে তার ওপরে রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট, গাছের ঝরা পাতা এসব দিয়ে দিয়ে ঢেকে রাখি। কিছুদিন পরপর ওপরে এক স্তর করে মাটি দিই। এভাবে করে রেখে দিই আট থেকে ১০ সপ্তাহ। কলার খোসা বা শর্ষের খইল পরিমাণমতো পানিতে পচিয়ে সেই পানিও গাছের গোড়ায় তরল সার হিসেবে দিই।
আমার ছাদবাগানে এখন মসলা, সবজি, ফল, ফুল আর পাতাবাহার—এই কয় ধরনের গাছ আছে। মসলার মধ্যে আছে অরিগ্যানো, আদা, কাঁচা হলুদ, থাই পাতা, অলস্পাইস (এই পাতাটা একই সঙ্গে সাতটি মসলার কাজ করে), ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, গোলমরিচ, তুলসী, পাঁচ ধরনের মরিচ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া পেঁয়াজ, রসুন গাছও আছে, যেগুলোর পাতাটাই বেশি রান্নাঘরে ব্যবহার হয়।
সবজি আর ফলের মধ্যে শসা, লেবু, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, ১০ থেকে ১২ রকম টমেটো, বিভিন্ন শাক, পেয়ারা, সবরি কলা, লেটুস, প্যাশন ফ্রুট, মালবেরি, ড্রাগন, ত্বিন ফল, স্ট্রবেরি, কুসুম আলু (একধরনের মিষ্টি আলু যেটা স্যালাড হিসেবেও খাওয়া যায়), মিষ্টি আলু, গোল আলু, ক্যাপসিকাম, জুকিনি, কমলা, টক পাতা, মেস্টা জবা বা মেস্টা ফল।এভাবেই আমার ছাদবাগান থেকে নিয়মিত শাকসবজি ও ফল পেয়ে থাকি, যা মোটামুটি আমার তিন সদস্যের পরিবারের সবজি চাহিদা পূরণ করে থাকে।