ছবির ফ্রেম বাঁধতে বাঁধতে ৭০০ চিত্রকর্ম সংগ্রহ করেছেন মিনাল
শিল্পীদের আঁকা ছবি বাঁধাই করতে করতেই হয়ে উঠলেন শিল্পানুরাগী। পেয়ে বসল চিত্রকর্ম সংগ্রহের শখ। তাঁর সংগ্রহে আছে প্রায় ৭০০ চিত্রকর্ম। সেসব থেকে বাছাই ৫৬টি শিল্পকর্মের প্রদর্শনী করলেন মিনাল মণ্ডল। ৬ জুন প্রদর্শনীর শেষ দিনে তাঁর শিল্পসংগ্রাহক হয়ে ওঠার গল্প শুনে এসেছেন কবীর হোসাইন
লালমাটিয়ার ‘শিল্পাঙ্গন গ্যালারি’র দেয়ালজুড়ে ঝুলছে বিখ্যাত সব চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম। পাশের কক্ষে ছোট্ট একটা গোলটেবিল। বৃত্তাকারে তিনটি চেয়ার। মুখোমুখি বসে নিজের বিয়ের গল্প করছিলেন মিনাল মণ্ডল, ‘কাইয়ুম (চৌধুরী) স্যার তখন অসুস্থ। সেই অসুস্থ শরীর নিয়াই স্যার আমার বউভাতের প্রোগ্রামে আসছিলেন। (রফিকুন) নবী স্যার, নিসার (হোসেন) স্যারও আসছিলেন। জাপানি দুজন আর্টিস্টও ছিলেন। আমার জন্য এইটা একটা বিরাট পাওয়া।’
মিনাল মণ্ডলের মুখের ভাষা মেদহীন ঝরঝরে, অপ্রমিত। ঠিক যেমন নির্মেদ নিজের শরীর। খেটে খাওয়া, বাহুল্যবর্জিত পরিশ্রমী দেহ। পেশায় ছবি বাঁধাইকারী। আর নেশায়? হ্যাঁ, ঠিক এই জায়গাটিতেই মিনাল মণ্ডল এক বিস্ময়ের নাম। একজন ছবির ফ্রেম বাঁধাইকর, প্রচলিত অর্থে যিনি বিত্তবান নন, প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নন; কিন্তু মননে বিপুল বৈভবের অধিকারী। সেই বৈভব শিল্পের সমঝদারিতে। চিত্রকর্ম বাঁধাইয়ের কাজ করতে করতে কৈশোরেই এই শিল্পের প্রতি যে ঘোর তৈরি হয়েছিল, সেটিই তাঁকে ঠেলে দেয় চিত্রকর্ম সংগ্রহের দিকে। এখন তাঁর সংগ্রহের সংখ্যা প্রায় ৭০০। এর মধ্যে কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, কালিদাস কর্মকার, বীরেন সোম, আবুল বারক আলভী, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, অলোকেশ ঘোষ, নিসার হোসেন, কনকচাঁপা চাকমার আঁকা শিল্পকর্ম যেমন আছে, তেমনি আছে নবীন শিল্পীদের কাজও। সেগুলো থেকে বাছাই করে ৩৮ জন শিল্পীর ৫৬টি চিত্রকর্ম নিয়েই শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে প্রদর্শনীর আয়োজন।
এত টাকা দিয়ে এসব জিনিস মানুষ কেনে কেন!
মিনাল মণ্ডল জন্মেছেন ১৯৮০ সালে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নরকান্দা গ্রামে তাঁদের বাড়ি। পড়াশোনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল না। ‘ছাত্র হিসাবে ভালো ছিলাম না। কোনো দিন কোনো পরীক্ষায় পাস করি নাই। কীভাবে কীভাবে জানি ফাইভ পর্যন্ত পড়ছিলাম’—মিনাল নিজেই বলেন অসংকোচে।
১৯৯৪ সালে কাজের খোঁজে ঢাকায় চলে আসেন মিনাল। ওঠেন বড় ভাইয়ের বাসায়। বড় ভাই তখন একজন শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতেন। এরপর তিনি আজিজ সুপার মার্কেটে ছবির ফ্রেম বাঁধাইয়ের একটা দোকান দেন। ভাইয়ের সঙ্গে সেখানেই কাজ শুরু করেন। কাজের সূত্রে শিল্পাঙ্গন আর্ট গ্যালারির উদ্যোক্তা ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে পরিচয় । মিনাল তখন নেহাতই কিশোর।
ফয়েজ আহমেদ তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তাঁর আগ্রহে বড় ভাইসহ মিনাল চলে আসেন শিল্পাঙ্গনে। এখানে কাজ শুরু করেন। তবে চিত্রকর্ম ব্যাপারটি তখনো তাঁর কাছে বিশেষ অর্থবহ নয়। ভাইয়ের সঙ্গে ফ্রেম বাঁধাই করতেন আর ভাবতেন, এসব জিনিস মানুষ এত টাকা দিয়ে কেনে কেন! কী আছে এতে! গ্রামের মেলা থেকে দুই-দশ টাকায় যে রংচঙে পোস্টার কিনতেন, সেগুলোই তো কত সুন্দর। এই ভাবনা অবশ্য বেশি দিন থাকেনি।
১৯৯৭ সালে শিল্পী রফিকুন নবীর একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়। সেই প্রদর্শনীর ছবি বাঁধাইয়ের কাজ করতে গিয়ে ছবির প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হয়। কাছাকাছি সময়ে স্পেনের কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর ছবি নিয়ে ঢাকায় একটি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। সেটিও তাঁকে নাড়া দেয়। এভাবে বিভিন্ন শিল্পীর সান্নিধ্য, শিল্পকর্ম বাঁধাই আর প্রদর্শনীর সাজসজ্জা করতে গিয়ে মিনালের ভেতরকার শিল্পীসত্তাটা জেগে ওঠে। ছবিগুলো অর্থপূর্ণ হয়ে ধরা দিতে থাকে।
পেয়ে বসে সংগ্রহের শখ
১৯৯৭ সালের কোনো একদিন। গ্যালারি শিল্পাঙ্গনের ব্যবস্থাপক তখন শিল্পী মনিরুজ্জামান। তিনি তাঁর দুটি চিত্রকর্ম শিল্পাঙ্গনের একজন প্রহরীকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রহরী সেগুলো মিনাল মণ্ডলকে দিয়ে দেন। খুব আগ্রহভরে ছবি দুটি নিলেন। সেই শুরু, তাঁর ভেতরে শিল্প সংগ্রহের নেশা হয়ে যায়। হাতে কিছু টাকা এলেই পছন্দমতো চিত্রকর্ম সংগ্রহ করতেন। অল্প আয়ের মানুষ। হাতে আর কত টাকাই–বা আসত। অনেক শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনীর কাজ করে দিয়ে টাকার বদলে ছবি নিতেন। উপহার হিসেবেও পেতেন কারও কারও কাছে থেকে। ঋণ করেও কিনেছেন অনেক ছবি। এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মিনালের সংগ্রহ।
বিদেশবিভুঁইয়ে রংতুলি
২০০৭ সালের শুরুর দিকে দুবাই চলে যান মিনাল মণ্ডল। আসলে হয়েছিল কি, বড় ভাইয়ের সঙ্গে তখন মনোমালিন্য চলছিল। সম্পর্ক বেশি খারাপ হলে ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করা ছেড়ে দেন। একটু সংকটেও পড়েন। কী করবেন ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নেন বিদেশে যাবেন।
দুবাইয়ে নির্মাণশ্রমিকের কাজ নেন মিনাল। শিল্প–অন্তঃপ্রাণ মানুষ, অন্য কাজে মন বসে না। সাতপাঁচ ভেবে একদিন কিনে ফেলেন রংতুলি। বিখ্যাত সব শিল্পীর ছবি আঁকতে দেখেছেন খুব ঘনিষ্ঠভাবে। শিল্পকর্ম বাঁধাইয়ে দক্ষ হয় উঠেছিলেন যেমন, তেমনি আঁকাআঁকিতেও ভেতরে-ভেতরে একটা অদৃশ্য ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল যেন। সারা সপ্তাহ শেষে যে দিনটি অবসর পাওয়া যেত, বসে যেতেন রংতুলি-ক্যানভাস নিয়ে। সেখানকার বিরান মরুভূমি, মরুভূমির বুকে উট, খেজুর গাছ—প্রভৃতি আঁকতে শুরু করলেন। সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে নিজের আঁকা দুটি ছবিও রেখেছিলেন মিনাল।
শিল্পের দুনিয়ায় ফেরা
২০১০ সালে দেশে ফিরে আসেন মিনাল। নিউমার্কেটে একটি দোকান ভাড়া নেন। শিল্পীদের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কটা আবার নবায়ন করেন। কিন্তু ব্যবসায়ের স্থান হিসেবে নিউমার্কেট খুব একটা সুবিধাজনক মনে হয় না। মাস ছয়েক পরই দোকানটি ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে। সেখানকার একটি অংশ ভাড়া নিয়ে নতুন করে শুরু করলেন ছবি বাঁধাইয়ের কাজ। এখানে কাজ করতে করতেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে কাজের সুযোগ ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ফরাসি চিত্রগ্রাহক মার্ক রিবুর তোলা আলোকচিত্রগুলো বাঁধাইয়ের কাজ করেন তিনি। কাজের গুণগত মান দেখে ফরাসি পক্ষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে।
বর্তমানে জামালপুর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য ছবি বাঁধাইয়ের কাজ করছেন মিনাল। কেরানীগঞ্জে তাঁর ছবি বাঁধাইয়ের দোকান আছে। তবে বাইরে অনেক বেশি কাজ থাকায় সেখানে বেশি সময় দিতে পারেন না।
প্রবীণ-নবীন প্রায় সব শিল্পীর সঙ্গেই মিনালের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল ও আছে। তাঁদের অনেকের চিত্রকর্ম নিজের সংগ্রহে আছে। তবে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ও এস এম সুলতানকে তিনি পাননি। তাঁদের চিত্রকর্মও নেই। নিজের সংগ্রহের এই অপূর্ণতাটা নিয়ে তাঁর আফসোস আছে।
এই যে ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে এত টাকা খরচ করেন, পরিবারের লোকজন কিছু বলে না? এই প্রশ্নটিও তাঁকে একটু আফসোসের মধ্যে ফেলে দেয়। তিনি বলেন, ‘তারা এগুলা বোঝে না। আমার মা তো কয়, এই কাগজ কিইন্যা ট্যাহা-পয়সা সব শ্যাষ করছে। আমি মায়েরে কিছু কই না। ট্যাকা খরচ কইরা যে জিনিস আমি সংগ্রহ করি তা যে কত অমূল্য, সেইটা তো আমি জানি।’