গল্পটা শুধু একটি রুপা ও তিনটি ব্রোঞ্জপদকের নয়
মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়ায় ১৪ থেকে ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হলো ইউরোপিয়ান গার্লস ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াড (ইজিএমও)। বলা হয়, মেয়েদের নিয়ে আয়োজিত গণিত প্রতিযোগিতাগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের প্রায় অনুরূপ এই প্রতিযোগিতায় বুদ্ধি ও গাণিতিক দক্ষতার লড়াইয়ে অংশ নেয় সারা বিশ্বের ৫৫টি দেশের ২১৪ জন অনূর্ধ্ব–২০ নারী। এ বছর ইজিএমওতে প্রথমবারের মতো সশরীর অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশের একটি দল। দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এর আগে দুবার অনলাইনে যোগ দিয়েছে দলটি। দুবারই পদক পেয়ে সামনের পথ অনেকটা উজ্জ্বল করে দিয়েছে আমাদের মেয়েরা।
দুই মাস আগেও অবশ্য আদৌ ইজিএমওতে যাওয়া হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কারণ, আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। ৪ জনের দল, ১ জন দলনেতা ও ১ জন উপদলনেতাকে ইউরোপে পাঠানোর মতো খরচ বহন করবে, এমন কোনো পৃষ্ঠপোষক মিলছিল না।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঈপ্সিতা বহ্নির (গণিত ক্যাম্পের একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর) একটা বার্তা পাই, ‘মনে হয়, এ বছর আর যাওয়া হলো না।’ কিন্তু আমাদের জন্য এ অংশগ্রহণ যে খুব জরুরি। প্রথমত, মহামারির ধাক্কার পর আবার গণিতের এ আসরে সব দেশের প্রতিযোগীরা এক হচ্ছেন, সশরীর উপস্থিতির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হওয়ার এটি ভালো সুযোগ। দ্বিতীয়ত, ২০২১ ও ২০২২ সালে আমাদের মেয়েদের গণিত দলটি বেশ ভালো ফল পেয়েছে। সেই ধারা ধরে রাখতেও এ বছর অংশগ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রতিযোগীদের পুরো বছরের পরিশ্রম ও অনুশীলন তো আমরা বিফলে যেতে দিতে পারি না।
শেষ চেষ্টা হিসেবে আমরা ক্রাউড ফান্ডিং (গণতহবিল) করার সিদ্ধান্ত নিই। বাংলাদেশ গণিত দলের কোচ অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার এ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ধাপে সাহায্য করেন। সমর্থন দেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের সাবেক অংশগ্রহণকারী জাদিদ হাসানও (উপদলনেতা, বাংলাদেশ নারী গণিত দল) আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় সব প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ডে। অংকুর ফাউন্ডেশনের সহায়তায় আমরা ক্রাউড ফান্ডিং শুরু করি।
একসময় আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের পাশাপাশি রোয লিমন ক্রেডিট রিপোর্ট অ্যান্ড কালেকশন, আবদুল মোনেম লিমিটেড, এন এস কনস্ট্রাকশনের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আয়োজন, ভিসা, টিকিটসহ নানা খরচ আমরা জোগাড় করে ফেলি।
কয়েকটি ধাপে নির্বাচিত চারজনের দল নিয়ে আয়োজন করা হয় চার দিনের আবাসিক ক্যাম্প। ১২ এপ্রিল স্লোভেনিয়ার পথে রওনা হয় বাংলাদেশ দল। প্রথম দুদিন ধরে চলে বাকিদের সঙ্গে পরিচিতি পর্ব। এরপর পরীক্ষা। দলনেতা হিসেবে এ সময়ে আমার কাজ ছিল বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি ও নম্বরের প্রক্রিয়া নিয়ে অন্যান্য দেশের দলনেতা, সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। পরীক্ষার পরদিন খাতা নিরীক্ষণের পেছনেই আমার ও উপদলনেতার পুরোটা সময় কেটেছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা বেড়াতে গিয়েছিল রাজধানী লুবলিয়ানাতে। সালসা কর্মশালায় অংশগ্রহণ, নানা খেলাধুলা আর ধাঁধা সমাধানের মধ্য দিয়ে ভালো সময় কেটেছে তাদের।
শেষ দিন অবশ্য আমাদের সবার একসঙ্গে পোস্তনিয়া গুহায় বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এরপর আমরা চলে যাই সমাপনী অনুষ্ঠানে, যেখানে বিশ্বের বেশ কয়েকজন বড় মাপের গণিতবিদ হাজির হয়েছিলেন। এমনকি ২০২২ সালের ফিল্ডস মেডেলপ্রাপ্ত (যেটাকে গণিতের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ধরা হয়) ইউক্রেনীয় গণিতবিদ মেরিনা ভিয়াজোভস্কাও ছিলেন। তাঁদের হাত থেকেই পদক গ্রহণ করে আমাদের মেয়েরা। গণিত–কন্যাদের চমৎকার ফলাফল এবার আমরা মঞ্চে উপস্থাপিত হতে দেখি। দলের প্রত্যেকেই সমাপনীতে পদক পেয়েছে। মাত্র ২ নম্বরের জন্য নুজহাত আহমেদের স্বর্ণপদক হাতছাড়া হলেও রৌপ্যপদক পেয়েছে সে। আরিফা আলম, আফসানা আকতার ও প্রথম অংশগ্রহণেই সানিভা রাকিব পেয়ে যায় ব্রোঞ্জপদক।
৫৫টি দেশের মধ্যে ২০তম হয়েছে বাংলাদেশ দল। পাশাপাশি প্রতিযোগিতার সবচেয়ে কঠিন ৬ নম্বর জ্যামিতিক সমস্যার সমাধান করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তারা। সামনের দিনগুলোতে নিশ্চয়ই মেয়েরা আরও বড় চমক দিতে পারবে।