এতিমখানায় বেড়ে ওঠা দুই ভাই এখন পুলিশ
মাত্র আড়াই বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন ইউসুফ আলী। বাবা হাসেন আলী ছিলেন সহায় সম্বলহীন দিনমজুর। স্বামী মারা যাওয়ার পর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন মা দোলেনা বেওয়া। দুই সন্তানের মুখে এক মুঠো খাবার তুলে দিতে কখনো চাতালশ্রমিকের কাজ করেছেন, কখনো গ্রামে গ্রামে শাড়ি ফেরি করেছেন। কিন্তু সেই উপার্জনেও ঠিকমতো সংসার চলত না।
শেষ পর্যন্ত দুই ভাইয়ের ঠাঁই হয় জয়পুরহাট সরকারি শিশু পরিবারে। সরকারি এই এতিমখানাতেই বড় হয়েছেন দুজন। পড়ালেখা করেছেন। এসএসসি, এইচএসসি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছেন স্নাতকে। তাঁরা এখন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সদস্য। বড় ভাই ইসমাইল আকন্দ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কনস্টেবল পদে আছেন প্রায় তিন বছর। ছোট ভাই ইউসুফ আলীও এ বছর পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নির্বাচিত হয়েছেন। পড়ালেখাও চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। জয়পুরহাট সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়ছেন ইউসুফ। আর ইসমাইল পুলিশের চাকরির পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক করছেন।
শারীরিক, লিখিতসহ বিভিন্ন পরীক্ষা শেষে পুলিশ কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করেন বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী। নিজের নাম শুনে কেঁদে ফেলেন ইউসুফ।
গত ৬ এপ্রিল গাবতলী উপজেলার শিলদহ গ্রামে দোলেনা বেওয়ার সঙ্গে কথা হলো। শারীরিকভাবে তিনি বেশ অসুস্থ। বললেন, ‘শিশুসন্তান রেখে চাতালে কাজে যেতে সমস্যা হতো। বাধ্য হয়ে ২০০৬ সালে বড় ছেলে ইসমাইল আকন্দকে শিশু পরিবারে রেখে আসি। ২০০৮ সালে রেখে আসি ছোট ছেলে ইউসুফকে। এতিমখানায় কষ্ট করে বড় হওয়া দুই ছেলে এখন পুলিশে চাকরি পেয়েছে। গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। এত দিন মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই করতে পারিনি। ভাইয়ের বাড়িতে একটা ঘরে কোনো রকম ছেলেদের নিয়ে থাকি। চাকরির উপার্জনে ছেলেরা একটা বাড়ি করবে বলেছে।’
ইউসুফ বলেন, ‘বগুড়া জেলায় পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে এতিম কোঠায় ১২০ টাকা জোগাড় করে আবেদন করি। কয়েক ধাপে পরীক্ষা শেষে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছি। শৈশব থেকে এতিমখানায় বড় হওয়ায় জীবনে মায়ের কোনো ইচ্ছাই পূরণ করতে পারিনি। এবার চাকরি করে মায়ের জন্য কিছু করতে চাই। পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাব। ২৫ এপ্রিল থেকে টাঙ্গাইল পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে শিক্ষানবিশ কনস্টেবল পদে প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার কথা আছে। সততার সঙ্গে চাকরি করে আমি মানুষের সেবা করতে চাই, পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চাই।’
বড় ভাই ইসমাইল আকন্দের সঙ্গে ইউসুফই মুঠোফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ইসমাইল বলেন, ‘এতিমখানায় আমাদের শিক্ষকেরা খুব আন্তরিক ছিলেন। মা-বাবার মতোই তাঁরা স্নেহ-আদরে লালন-পালন করেছেন। তাঁদের অনুপ্রেরণাতেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। ২০১৬ সালে জয়পুরহাট কাশিয়াবাড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪ নিয়ে এসএসসি পাসের পর সিরাজগঞ্জ সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই। বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এসএসসি পাসের পর সেনাবাহিনীর সৈনিক, পুলিশ কনস্টেবল, নৌবাহিনীর সদস্য, বিজিবির জওয়ান পদে চাকরির জন্য একের পর এক অংশ নিয়েছি। অবশেষে ২০১৯ সালে এতিম কোঠায় পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল বাছাইয়ে উত্তীর্ণ হই। প্রশিক্ষণ শেষে ডিএমপিতে যোগদান করেছি।’
বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারার কারণেই ইউসুফদের মতো অসহায় তরুণেরাও এবার ১২০ টাকায় আবেদন করে চাকরি পেয়েছে।’