কাপড়ের দোকানি থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
বাবার সঙ্গে অভিমান করে ১৩ বছর বয়সে ভারত ছেড়ে বর্তমান বাংলাদেশে আসেন লতিফ আহামেদ। তারপর রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রামে কাটে তাঁর কষ্টের জীবন। টিউশনি করেছেন, মানুষের বাড়িতে থেকেছেন, কিন্তু পড়াশোনা থামাননি। পথে পথে ঘোরা সেই মানুষটাই একসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। তাঁর জীবনের আরও গল্প শুনেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
বেশ কয়েক বছর হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে অবসরে গেছেন লতিফ আহামেদ। এখন রাজশাহী শহরের কাটাখালী এলাকায় স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। একমাত্র মেয়েটার বিয়ে দিয়েছেন। বই পড়ে ও বই অনুবাদ করে কাটছে তাঁর অবসরজীবন। খুব মজা করে কথা বলেন লতিফ আহামেদ। গল্পে গল্পে তাঁর জীবনের নানা ঘটনা শুনেছি। বলতে বলতে কখনো চোখ মুছেছেন, কখনো আনন্দে হেসেছেন। গল্পের মতোই তাঁর জীবন।
শৈশবে দেশছাড়া
লাহারপুর একটি মহকুমা শহর। ভারতের উত্তর প্রদেশের সীতাপুর জেলার এ শহরের এক উর্দুভাষী পরিবারে লতিফ আহামেদের জন্ম। তাঁর বাবা সৈয়দ মুসির আহামেদ কিরমানি ছিলেন হেকিম, মা খাদিজা বেগম গৃহিণী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে লতিফ আহামেদ বড়।
১৩ বছর বয়সে হিফজ (কোরআনে হাফেজ) সম্পন্ন করেন লতিফ আহামেদ। এরপর তাঁর বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়ুক। কিন্তু লতিফ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। বাদ সাধেন বাবা। সৎমায়ের ইন্ধনে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। সে সময় বাবা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘মানুষের মতো মানুষ হলেই তবে বাড়িতে ফিরতে পারবে।’ দিনটা ছিল ১৯৬০ সালের ২৪ মার্চ।
রংপুরের হাজি সাইমুদ্দিন ছিলেন লতিফ আহামেদের বাবার বন্ধু। তাঁর সঙ্গেই ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পা বাড়ালেন লতিফ। রংপুরে এসে সাইমুদ্দিনের বাড়িতেই তাঁর জায়গা হলো। সেখানে দেড় বছর থাকার পর কাসিম আলী নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে আরও দুই বছর থাকলেন। এ সময় কায়েদে মিল্লাত মেমোরিয়াল হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন লতিফ আহামেদ।
রংপুর থেকে রাজশাহী
বাড়ি থেকে কোনো সহযোগিতা নেই। অন্যের দয়ায় থাকা-খাওয়া-পড়াশোনা। এর মধ্যে এক উটকো বিপদ। তিনি রিকশায় যাচ্ছিলেন। আর একটি বাঙালি মেয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। মেয়েটা ভালো চালাতে জানত না। রিকশার সঙ্গে সাইকেলের সংঘর্ষে দুজনেই পড়ে যান। সাইকেলের বেলের একটা অংশ লতিফের হাতে ঢুকে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। মেয়েটি একবার রক্তের দিকে তাকায় আবার লতিফের মুখের দিকে। কিছুদিন পরে লতিফ বুঝতে পারেন মেয়েটি তাঁর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। পড়াশোনার ক্ষতির আশঙ্কায় তিনি নীরবে রংপুর ছাড়েন।
রংপুর ছেড়ে চলে আসেন রাজশাহী। এখানে তাঁর এক মামা কাস্টমসে চাকরি করতেন। রংপুর ছাড়ার খবর পেয়ে লতিফ আহামেদের বাবা তাঁকে ভারতে ফিরে যাওয়ার জন্য চিঠি লিখলেন। কিন্তু তাঁর মামা পরামর্শ দিলেন ভারতে ফিরলে তাঁর পড়াশোনা হবে না। রাজশাহী নগরের আলুপট্টিতে ওয়ালী মঞ্জিল নামের একটি বাড়িতে তাঁর টিউশনি ঠিক হলো। উর্দুভাষী পরিবার। মাসিক বেতন ১০ টাকা।
১৯৬৫ সাল। লতিফ আহামেদের মামা সৈয়দ গণি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। তখন নগরের সোনাদিঘির মোড়ের তাহের নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে তাঁর খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। মানুষটি রংপুরের। এভাবে রাজশাহীর মুসলিম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ পাস করলেন। ১৯৬৮ সালের ১৮ জুন তিনি ঢাকার উদ্দেশে রাজশাহী ছাড়লেন।
ঢাকায় নিরুদ্দেশ যাত্রা
কোথায় কার কাছে যাবেন, কিছু ঠিক নেই। কাছে কোনো টাকাপয়সাও নেই। ঠিক ভবঘুরের মতো। স্টেশনে নেমে ধানমন্ডির দিকে হাঁটা ধরলেন। হঠাৎ তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা, নাম সৈয়দ কায়সার ঈমাম। রাজশাহী বনগ্রামে থাকতেন। কায়সার তাঁর মেসে নিয়ে গেলেন। মাসখানেক সেখানে থাকার ব্যবস্থা হলো। এরই মধ্যে কায়সার একটি টিউশনি ঠিক করে দিলেন। দুটি মেয়েকে উর্দু শেখানোর কাজ। বেতন মাসে ৫০ টাকা। তখন তাঁর আর অভাব রইল না। ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু একই সময়ে টিউশনি থাকায় শেষ ক্লাসটা আর করতে পারতেন না। এ জন্য পরীক্ষা দেওয়ার সময় ‘ডিসকলেজিয়েট’ হয়ে গেলেন। লতিফ আহামেদের ভাষায়, ‘কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শ্বশুর জালাল (উদ্দিন আহমেদ) সাহেব। খুব কড়া মানুষ ছিলেন। অনিয়ম সহ্য করতেন না।’
ঢাকা কলেজ থেকে তাঁর আর বিএ পরীক্ষা দেওয়া হলো না।
একটি বিরল অভিজ্ঞতা
দুই বছর পড়ে পরীক্ষা দেওয়া না হলেও ঢাকা কলেজে পড়ার সুবাদে তাঁর একটি বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে কামাল এই কলেজে ঠিক তাঁর নিচের ক্লাসে পড়তেন। হালকা পরিচয় ছিল। লতিফ আহামেদের মনে আছে, ‘১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু বাড়িতে আসছেন। কামাল এসে বললেন, বাবাকে দেখতে যাবেন? তখন আমি আর বন্ধু শাহাদত হোসেন (পরে এনএসআইয়ের পরিচালক) ৩২ নম্বরে গেলাম। বঙ্গবন্ধু টি-শার্ট আর প্যান্ট পরে জিপ থেকে নামলেন। ওই রকম পোশাকে আর কোনো দিন তাঁকে দেখিনি। কামাল পরিচয় করিয়ে দিলেন। হ্যান্ডশেক করলেন। এত নরম হাত! বঙ্গবন্ধুর হাতের স্পর্শটা এখনো যেন হাতের মধ্যে অনুভব করি।’
খালি পায়ে চট্টগ্রাম
ঢাকায় পরীক্ষা দেওয়া হলো না। ভীষণ মন খারাপ লতিফের। তিনি বললেন, ‘চট্টগ্রামে বাবার বন্ধু মুনসুরুল হক ছিলেন। পাটনার লোক। তাঁর কাছে চলে গেলাম।’
১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হলেন। ওখানেও আয় বলতে টিউশনি। সেখানে একদিন রাস্তায় দেখা রাজশাহীর বাঙালি ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। পূর্বপরিচিত লোকটা লতিফ আহামেদকে খালি পায়ে দেখে বুঝতে পারেন, ছেলেটার আর্থিক অসংগতির ব্যাপারটা। লতিফ আহামেদকে ধরে রাজশাহীতে নিয়ে আসেন সেই ব্যবসায়ী। সেই বছর ২০ সেপ্টেম্বর তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। লতিফ আহামেদ বলেন, ‘অসহায় অবস্থায় একটু ঠিকানার আশায় সেই বিয়েতে মত দিই। যুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে দুবার মরতে গিয়ে বেঁচে যাই। একবার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আর একবার মিলিটারির খপ্পরে পড়েছিলাম। বরাবরই বাঙালি ছেলেদের সঙ্গে মিশতাম। এক বন্ধুর বোন আমাকে বাঁচিয়েছিলেন।’
কাপড়ের দোকানি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
লতিফ আহামেদ বলে যান, ‘যুদ্ধ শেষে শাশুড়ি আমাকে ৭০০ টাকা পুঁজি দিয়ে কাপড়ের দোকান করে দিলেন। ব্যবসা খুব ভালো হলো। এরই মধ্যে আমি স্নাতক সম্পন্ন করে নিয়েছি।’
১৯৮০ সালে লতিফ আহামেদের বাবা জায়গা-জমি বিক্রি করে সৎমাকে নিয়ে ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যান। লতিফ আহামেদ ভারতে গিয়ে তাঁর মাকে নিয়ে আসেন বাংলাদেশে, নিজের কাছে। ২০০৪ সালে রাজশাহীতে মারা যান তিনি। দিল্লিতে স্থায়ী হয়েছেন তাঁর ছোট ভাই। আর বোনটি বিয়ের আগেই মারা গেছেন।
লতিফ আহামেদকে জিজ্ঞেস করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলেন কখন? তিনি বলেন, ‘একদিন আমার দোকানে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কলিম (শাহসারামি) সাহেব জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু বিভাগ খোলা হয়েছে, আমি যেন স্নাতকোত্তর ভর্তি হই। তাঁর পরামর্শে পরের বছর ১৯৮৯ সালে স্নাতকোত্তর দিলাম। প্রথম বিভাগে পাস করলাম।’
তারপর ব্যবসাই করছিলেন। পাঁচ বছর পর সেই শিক্ষকই আবার এসে লতিফ আহামেদকে বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নেওয়া হবে। তুমি আবেদন করো।’ আবেদন করলেন লতিফ আহামেদ। ১৯৯৪ সালে ৭ জুন উর্দু ভাষা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। ২০০৬ সালে পিএইচডি করেন। ২০১২ সালে অধ্যাপক হয়ে অবসরে যান। লতিফ আহামেদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘পথে পথে পড়াশোনা করতে গিয়ে সময় লেগে গেল বেশি। তাই চাকরির সময়টা কম পেলাম।’
বাঙালির ত্যাগের ইতিহাস
প্রবন্ধ, গল্পসহ বিভিন্ন বিষয়ে লতিফ আহামেদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১২। কানাডা থেকে প্রকাশিত উর্দুভাষীদের এক ম্যাগাজিনেও তাঁর গল্প ছাপা হয়েছে। সম্প্রতি আনিসুল হকের মা উপন্যাসের অনুবাদ শেষ করেছেন।
লতিফ আহামেদ বলেন, ‘অনেক সংগ্রাম করে একটা উন্নত জীবন পেলাম। তবে এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হাতের স্পর্শটা ভুলতে পারি না। এই স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখার জন্য ব্যারিস্টার কাজী আহমেদ কামাল রচিত শেখ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড দ্য বার্থ অব বাংলাদেশ বইটির উর্দু অনুবাদ করলাম। পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় তার রিভিউ ছাপা হয়েছে। আর সর্বশেষ মা উপন্যাসের অনুবাদটি গত জুন মাসে শেষ করতে পেরেছি। বইটি প্রকাশিত হলে উর্দুভাষী মানুষ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালির ত্যাগের ইতিহাসটি জানতে পারবে।’