মুখে না দিয়েও আমের স্বাদ বোঝা যাবে ‘ইলেকট্রনিক নাক’ দিয়ে
‘আম মিষ্টি হবে তো?’ শুরুতেই আমরা জিজ্ঞেস করি বিক্রেতাকে। তারপর নেড়েচেড়ে দেখি, ঘ্রাণ নিই। ঝুড়ি থেকে বেছে বেছে ভালোগুলো তুলে নিই। এত ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’র পরও অনেক সময় বাড়ি ফিরে দেখা যায়, আম ভালো পড়েনি। এবার সত্যিকার অর্থেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমের মান নির্ণয়ের পদ্ধতি বের করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি দল। তাঁরা দাবি করছেন, তাঁদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে আম না কেটেই এর মিষ্টতা ও পরিপক্বতা পরীক্ষা করা সম্ভব।
গবেষণাকাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক আনিসুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন একই বিভাগের দুই শিক্ষার্থী কাজী সাকিবুর রহমান ও এম মিরাজুস সালেহীন। ইতিমধ্যে গবেষণাপত্রটি কিউ-ওয়ান ক্যাটাগরির জার্নাল স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার টেকনোলজিতে প্রকাশিত হয়েছে। এতে কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক চয়ন কুমার সাহা ও তিন শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম, জয়শ্রী ভদ্রা ও ঋতুপর্ণা রায় কাজ করেছেন।
আমের মিষ্টতা নির্ণয়ের এই প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে ‘ই-নোজ’, যা এম-কিউ সেন্সরের মাধ্যমে কাজ করে। কেন এই নাম? অধ্যাপক আনিসুর রহমান বললেন, ‘আমের গুণমান বুঝতে আমরা ঘ্রাণ শুঁকি, নাকের কাছে নিই। সেই একই কাজ যন্ত্র দিয়ে করা হচ্ছে বলে এর নাম ই-নোজ বা ইলেকট্রনিক নাক। কাঠামোটি তৈরিতে স্বল্পমূল্যের চারটি এমকিউ সেন্সর, একটি রাস্পবেরি পাই, ১২ ভোল্টের ব্যাটারি, ভোল্টেজ কনভার্টার, আর্ডিনো মেগা ও বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ৪০-৪৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।’
ই-নোজের চারটি অংশ—গ্যাস চেম্বার, সেন্সর চেম্বার, ডেটা কন্ট্রোলার ও ডেটা স্টোর মডিউল। গবেষক দলের সঙ্গে কথা বলে এর কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা গেল—পরীক্ষার জন্য একসঙ্গে চার-ছয়টি আম গ্যাস চেম্বারে রাখা যায়। আমগুলো গ্যাস (ঘ্রাণ) নির্গত করতে থাকে। প্রতি ৩০ মিনিট পরপর এই গ্যাস সেন্সর চেম্বারে নেওয়া হয়। সেন্সরগুলো গ্যাসের ইলেকট্রনিক সংকেত তৈরি করে। সবশেষে উৎপন্ন সংকেতের ওপর ভিত্তি করে ডেটা স্টোর মডিউল আমের মিষ্টতা ও পরিপক্বতা নির্ণয় করে। অধ্যাপক আনিসুর রহমান দাবি করেন, এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০ মিনিটের মধ্যেই একটি আম পরীক্ষা করা সম্ভব।
দীর্ঘ আড়াই বছর গবেষণার পর দলটি সফল হলো। এর মাধ্যমে কৃষক-ব্যবসায়ী উভয়ই উপকৃত হবে বলে জানালেন গবেষক দলের প্রধান আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘জাপানে একই ফল কয়েকটি ভাগে বিক্রি করা হয়। একেকটার গুণগত মান একেক রকম থাকে। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে এমন একটা সময় আসবে, যখন বাংলাদেশের মানুষের আয় বাড়বে। তাঁরা বেছে বেছে ভালো মানের ফল, মিষ্টি ফল খেতে চাইবেন। তখন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো খাদ্য প্রস্তুত করতে পারবেন।’
কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী সাকিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৯৮.৩ শতাংশ পর্যন্ত সঠিক মিষ্টতা ও ৯৮.৫ শতাংশ পর্যন্ত সঠিক পরিপক্বতা নির্ণয় করা সম্ভব। সুতরাং এই গবেষণার প্রথম উপকারভোগী হবেন আমচাষিরা। রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বিঘার পর বিঘা আমবাগান রয়েছে। বাগানের চাষিরা কেবল তাঁদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে পরিপক্বতা ও মিষ্টতা বোঝার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ক্রেতারও ব্যবসায়ীর কথা বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় থাকে না। ফলে দেখা যায়, ক্রেতারা প্রায় সময় আম কিনে প্রতারিত হন। অন্যদিকে, জুস কোম্পানি সঠিকভাবে পরিপক্ব আম সংগ্রহ করতে না পারলে মান খারাপ হতে পারে। হাজার হাজার টন আমের মধ্য থেকে এক-দুটি আম পরীক্ষা করে জুস উৎপাদন করার মধ্যে অনেক ঝুঁকি থাকে। আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি আম যেমন পরীক্ষা করা যাবে, এক টন আমও করা যাবে।’