‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজের লেখক এই তরুণ
নেয়ামত উল্যাহ মাসুমকে যদি তাঁর নিজের জীবনের চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়, কোথা থেকে শুরু করবেন তিনি? হইচইয়ের সাড়াজাগানো ওয়েব সিরিজ কারাগার–এর গল্প ও চিত্রনাট্য তাঁর লেখা। তাকদির সিরিজেরও তিনি অন্যতম লেখক।
মাসুম কোথা থেকে শুরু করবেন জানি না। তবে আমরা একটা ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ দিয়ে শুরু করব।
আমরা একটা সিনেমা বানাব
সিনেমা নিয়ে কাজ করবেন, কোনো দিন ভাবেননি। এমনকি নোয়াখালী শহরে আসার আগে ভিসিআরে শুধু দুটি ছবি দেখেছিলেন মাসুম—টার্মিনেটর টু আর কাল হো না হো। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে গেলেন নোয়াখালী জিলা স্কুলে। তখন টেলিভিশনে সারা দিন খেলা দেখতেন। স্কুলে স্পোর্টস ক্যাপ্টেনও ছিলেন।
তবে সহপাঠীরা জানতেন না, তাঁদের ক্যাপ্টেন লুকিয়ে লুকিয়ে অঙ্ক খাতায় কবিতা লেখেন। এসএসসি পরীক্ষার আগে মাসুমের মাথায় কী এক ভূত ভর করল, কে জানে। ঠিক করলেন, সিনেমা বানাবেন। কাছের কিছু বন্ধুর মাথায়ও ভাবনাটা ঢুকিয়ে দিলেন। সবাই মিলে একটা গল্প লেখা হলো। ঠিক হলো, দলের মধ্যে যাঁরা ‘দেখতে সুন্দর’, তাঁরা অভিনয় করবেন।
সব ঠিক। কিন্তু ক্যামেরা কই?
বিয়েবাড়িতে ভিডিও করেন, এমন একজন ক্যামেরাম্যানকে পটিয়ে ফেললেন তাঁরা। ঠিক হলো, প্রতিদিন শুটের বিনিময়ে তাঁকে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। বিপুল উদ্যমে দুই দিন শুটিং হলো। তৃতীয় দিন মাসুমের বন্ধুর মায়েরা হেড স্যারের কাছে হাজির হলেন নালিশ নিয়ে। বিচারে হেড স্যার রায় দিলেন, এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে মাসুম আর সিনেমা বানাতে পারবেন না।
ইতি তোমারই ঢাকা
এসএসসি, এইচএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন মাসুম। আমরা যাঁকে বলি ‘গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ’। তারপর? মাসুম বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল, বুয়েটে ভর্তি হব।’ কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার দুই দিন আগে মাসুমের দাদা মারা গেলেন। বাবা থাকতেন দেশের বাইরে। তাই দাদা ছিলেন খুব কাছের মানুষ। খুব ভেঙে পড়লেন মাসুম। শোক কাটিয়ে যখন ঢাকায় পৌঁছলেন, তখন প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ। একে তো দাদাকে হারিয়েছেন, তার ওপর কোথাও ভর্তি হতে না পেরে হতাশা চেপে বসল।
পরিবার চেয়েছিল মাসুম যেন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ঢাকা শহর জায়গাটাই এমন, এখানে একবার ঢুকে পড়লে বের হওয়া মুশকিল। অতএব কয় দিন পর মাসুমের গলায় দেখা গেল ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) আইডি কার্ড।
তাকদিরে তকদির বদল
শতভাগ বৃত্তিসহ ইউল্যাবের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজমে ভর্তি হয়েছিলেন মাসুম। সেখানেই এমন কয়জন বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়, যাঁরা ‘সিনেমা করেন’। কিন্তু ষষ্ঠ সেমিস্টারে উঠে মাসুমের মনে হলো, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে তিনি কিছু নিতে পারছেন না। অতএব ড্রপআউট হলেন তিনি।
বড় ভাইদের সঙ্গে তত দিনে টুকটাক চিত্রনাট্য লেখা, সিনেমাটোগ্রাফি, পরিচালনার কাজ করেছেন। সেই সুবাদেই কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচয়। এভাবেই প্রজন্ম টকিজ নামে একটা প্রকল্পে সৈয়দ আহমেদ শাওকীদের সঙ্গে কাজ। এক দিন শাওকীকে বললেন, ‘ভাই, মাথায় একটা চরিত্র ঘুরছে। সে লাশবাহী গাড়ি চালায়। তাঁর মাথার কাছে সব সময় লাল বাতি জ্বলে, আর ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজতে থাকে।’ দুজনে মিলে সেই চরিত্রের মাথার ভেতর উঁকি দিতেই শেকড়, ডালপালা মেলে জন্ম নিতে লাগল তাকদির–এর গল্প আর চিত্রনাট্য।
আর কারাগার? মাসুম বলেন, ‘আমি এখন বসিলায় থাকি। আগে থাকতাম রায়েরবাজার। ওখানে আমাদের একটা ঘর আছে, আমরা বলি “জাঙ্কি”। ইউল্যাবের অনেকেই ওখানে গেছেন, থেকেছেন, এখনো থাকছেন। জাঙ্কি থেকে অনেক “সিনেমাম্যান” বের হয়েছেন, সামনেও হয়তো হবেন। তো এক দিন সবাই জাঙ্কিতে আড্ডাবাজি করেন, রাতে ছাদে শুয়ে ছিলাম। তখনই হঠাৎ কারাগাররে চঞ্চল চৌধুরীর চরিত্রটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।’
ইঞ্জিনিয়ার হলে আমাকে নিয়ে এই লেখাটা ছাপা হতো না
মাসুম জানান, কারাগারের গল্প লিখতে তাঁকে অনেকটাই সাহায্য করেছে ‘কাকতাল’। বলছিলেন, ‘কাকতাল হলো কেন্দ্রীয় কারাগারে জন্ম নেওয়া একটা ব্যান্ড। আমি নিয়মিত ওদের গান শুনতাম। ওদের কোনো স্থায়ী সদস্য নেই। কারণ, বন্দীরা কেউ হয়তো এক জেল থেকে অন্য জেলে চলে যায়। কেউ ছাড়া পায়। ফলে সব সময় সদস্য বদলায়।’
লেখালেখি তো চলছেই। তবে নিজের একটা সিনেমা বানানোর ইচ্ছে মাসুমের মাথা থেকে এখনো যায়নি। মনে মনে সেই গল্পটা খুঁজছেন তিনি।
জানতে চেয়েছিলাম, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এত ভালো রেজাল্ট করে এখন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছেড়ে ফিকশন লিখছেন, মা-বাবা ব্যাপারটা কীভাবে নিচ্ছেন? মাসুম বললেন, ‘আমার মা, বাবা, ছোট দুই বোন মিথিলা-মিতুল সবাই একসঙ্গে বসে আমার লেখা সিরিজ দেখে। ওরা চেয়েছিল, আমি যেন ইঞ্জিনিয়ার হই। আমিও চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন যা করছি, তা নিয়েও আমি খুশি। আমার মা–বাবাও গর্বিত। কিছু লোকে চেনেন, ভালো বলেন। পত্রিকায় আমাকে নিয়ে লেখা ছাপা হয়, এ জন্যই হয়তো। আমি যদি ইঞ্জিনিয়ার হতাম, তাহলে হয়তো আজ আমাকে নিয়ে এই লেখা ছাপা হতো না।’